হালতিবিলের হাঁস রাজ্য স্বাবলম্বী হচ্ছেন গ্রামীণ নারীরা
মোঃ মামুনুর রশীদ, নলডাঙ্গা (নাটোর) : চারিদিকে থৈথৈ করছে পানি। আকাশের কোথাও রৌদ্রময়, আবার কোথাও ভাসমান মেঘে আচ্ছাদিত পরিবেশ। বাতাসের শনশন শব্দ আর ছোট ছোট ঢেউয়ে পানির কলতানিতে যেন বিরাজ করছে এক ভিন্ন প্রকৃতি-পরিবেশ। এরইমধ্যে সাদা, কালো, ধুসর ও সাদ-কালো কিংবা দুই বর্ণের সংমিশ্রণের পাতি হাঁস, রাজহাঁস ও চিনহাঁসের প্যাঁক প্যাঁক ডাক আর ঢেউয়ের তালে তালে ডানা মেলে পানিতে খেলা করার দৃশ্যটি এক ভিন্ন আবহাওয়ার সৃষ্টি করে চারিপাশ। বর্ষা এলেই এমন মনমুগ্ধকর পরিবেশ দেখা মিলবে নাটোরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হালতিবিলে। এ বিলের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি আর পরিবেশ বিমোহিত করবে যে কাউকেই। সাথে রয়েছে হাঁস-পাক-পাখাালির রাজ্য। এছাড়া অথৈ জলের মাঝে ভেঁসে আছে ছোট ছোট গ্রাম। দেখতে মনে হবে অনেকটাই দ্বীপের মত।
এ বিলের মাঝে খোলাবাড়িয়া, হালতি, দিঘীরপাড়, একডালা, কেঁচকুড়িসহ আশপাশের গ্রামের প্রতি বাড়ির নারীরা লালন-পালন করছেন বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস। এসব হাঁস পালনে একদিকে তারা আর্থিক ভাবে স্বাবল¤ী^ হচ্ছেন, অন্যদিকে পূরণ করছেন মাংস ও ডিমের চাহিদা। বর্ষার অবসর সময়ে গল্প-আড্ডার ফাঁকে তারা হাঁসপালনে বাড়তি আয় করতে পেয়ে খুব খুশি। এজন্য প্রতিটি বাড়িতেই দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে হাঁস পালনে। সর্বত্রই হাঁসের বিচরণ দেখলে মনে হবে হালতিবিল যেন এক হাঁস রাজ্য।
জানা যায়, জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম হালতিবিলের প্রতিটি গ্রামের শতভাগ মানুষই কৃষিজীবী। কৃষি কাজই তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস। তাই মৌসুম এলেই সকল কৃষক চাষাবাদ করেন ধান, পাট, সরিষা, পেঁয়াজ, ভুট্টা, গমসহ হরেক রকম ফসল। তবে ফসল ঘরে তোলার পর বর্ষাকালীন সময় এখানকার মানুষের সময় কাটে অনেকটাই কর্মহীন। কেননা এসময় তাদের কোন কাজ থাকে না।
তাই পুরুষেরা পারিবারিক কাজকর্ম আর গবাদিপশু দেখাশুনার পর তাদের বেশির ভাগ সময় কাটে গল্প-আড্ডায়। আর গৃহস্থালীর কাজ শেষ করে কাঁথা সেলাই, নলি দিয়ে জাল বুনিয়ে সময় পার করেন গ্রামীণ বধূরা। ক্রমাগতভাবে গত কয়েক দশক ধরে এমন চিত্র বিরাজ করছিল হালতিবিলের গ্রামাঞ্চলে। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ অনেকটাই বদলে গেছে। গ্রামীণ নারীরা পুরোনো চিন্তা ভেদ করে গৃহস্থালীর কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগী পালনে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। বিশেষ করে হাঁস পালনে আর্থিক লাভবান বেশি হওয়ায় এটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা।
তাই বর্ষাকাল শুরুর প্রথম দিকে এবং বিলে বন্যার পানি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই এই বিলের গ্রামীণ নারীরা হাঁসের ডিম ও বাচ্চা সংগ্রহ করেন। অনেকে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটান। কেউ কেউ বাচ্চা কিনে পারিবারিক ভাবে হাঁস পালনে নেমে পড়েন। প্রাকৃতিক উৎস, বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার, শামুক-ঝিনুক, ধানের কুড়া, ধান-চাল আর ঘাস খেয়ে সহজেই লালন-পালন করতে পারেন রাজহাঁস, পাতি হাঁস ও চিনাহাঁস। খোঁজ নিলে দেখা মিলবে প্রতি বাড়িতে হাঁস লালন-পালন করছেন নারীরা। মাত্র ৪ থেকে ৫ মাসেই হাঁসগুলো হয়ে ওঠে পরিপক্ক এবং বিক্রি উপযোগী। এছাড়া ডিমপাড়া তো রয়েছেই।
একেকটি হাঁস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা দরে। তারা হাঁস আর ডিম বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অনায়াসে। কেননা এসব হাঁস পালনে তাদের বাড়তি কোন খরচ করতে হয় না। বরং বর্ষা মৌসুমে স্বল্প খরচে হাঁস পালনে খুব সহজেই আর্থিকভাবে সচ্ছলতা আসে তাদের। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার পাশাপাশি সংসারের বাড়তি খরচ মেটানো থেকে শুরু করে বোরো মৌসুমে চাষাবাদেও পরিবারকে খানিকটা সহযোগিতা করা যায়। তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সময় এসব হাঁস বিক্রি করে বোরো চাষাবাদের খরচ যোগান দিতে টাকা প্রস্তুত রাখেন তারা।
হালতিবিলের খোলাবাড়িয়া গ্রামের তানজিলা বেগম জানান, এবার বর্ষার শুরুতেই বিশেষ করে আষাঢ় মাসেই তিনি ৫০টি পাতি হাঁসের ডিম কিনে বাচ্চা তোলেন এবং লালন-পালন করে সেগুলোর মধ্যে ৪০টি বড় করেছেন। কিছু কিছু হাঁস ডিম দিচ্ছে এবং বেশির ভাগই মাংস খাওয়ার উপযোগী হয়েছে। যা বর্তমানে প্রতিটি হাঁস ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব হাঁস পালনে তেমন একটা খরচ হয় নি। কারণ বাড়িতেই ধানের কুড়া, চাল, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং বিলের শামুক-ঝিনুক খেয়ে বড় হয়েছে। বাড়তি কোন খাবার খাওয়াতে হয়নি। বর্তমান বাজারে বিক্রি করলে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা পাওয়া যাবে।
হাঁসপালনকারী ছালেহা বেগম, সাবিনা বেগমসহ অনেকেই জানান, প্রতিটি রাজহাঁসের বাচ্চা সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনতে হয় আর ডিমের দাম কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পড়ে। লালন-পালন শেষে প্রতিটি রাজহাঁস ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। প্রতিটি রাজহাঁস ৪/৫ মাস লালন-পালন করতে খুব সামান্য খরচ করতে হয়। কারন এসব হাঁস সারাদিন বিলের পানিতে থাকে। এই সময়ে ঘাস, পোকা-মাকড় খায়। সন্ধ্যা লাগলেই বাড়িতে ফিরে আসে। তবে বাড়িতে ধানের গুড়া, খড় এবং মাঝে মধ্যে খাবারের উচ্ছিষ্টসহ চাল খাওয়ানো হয়। বিলের হাঁস ফিড মুক্ত এবং স্বাস্থ্যসম্মত। এছাড়া এই হাঁস পালন লাভজনক বলে দাবি করেন তারা।
আরও পড়ুনএকই গ্রামের দরগাপাড়ার জহুরা বেগম জানান, প্রতিটি বাড়িতেই রাজহাঁস, পাতিহাঁস ও চিনাহাঁস রয়েছে। তবে পাতি হাঁস ও রাজহাঁসের পরিমান বেশি। পাতিহাঁস লালন পালনে ধানের কুড়া, চাল, খাবারের উচ্ছিষ্ট এবং বিলের শামুক-ঝিনুক প্রয়োজন হয়। আর রাজহাঁস ধান-চাল, বিভিন্ন রকম ঘাস খেয়ে বড় হয়। তিনি এবার ২০টি রাজহাঁস ও ৪৫টি পাতি হাঁস লালন-পালন করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিটি পাতি হাঁস ৫০০ টাকা, রাজহাঁস ২০০০ টাকা এবং চিনাহাঁস ১৪’শ থেকে ১৫’শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাড়ি থেকেই কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা। তবে মাঝে মধ্যে হাট-বাজারেও বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
একডালা গ্রামের আছিয়া বেগম বলেন, হাঁস পালন লাভজনক হওয়ায় তিনি এবার ৬০টির মত রাজহাঁস লালন-পালন করে বিক্রি উপযোগী করেছেন। ইতোমধ্যে ১০টি হাঁস ২ হাজার টাকা দরে বিক্রিও করেছেন। বোরো ধান চাষাবাদের আগেই সবগুলো বিক্রি করবেন। এছাড়া প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি পাতি হাঁস রয়েছে তার। তিনি বলেন, গ্রামের এমন কোন বাড়ি নেই যেখানে হাঁস নেই। একই কথা জানান, হালতি, দিঘিরপাড়, কোঁচকুড়ি গ্রামের নারীরা।
একডালা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় খাচুরা ইউপি সদস্য মোঃ জামাল হোসেন বলেন, বিল এলাকার হাঁস দেখতে যেমন সুন্দর এবং নাদুস-নুদুস, খেতেও বেশ দারুন। কারণ ফিড ছাড়াই প্রাকৃতিক উৎস থেকে শামুক খেয়ে হৃষ্টপৃষ্ট হয়েছে এসব হাঁস। যা স্বাস্থ্যসম্মত এবং স্বাদেও অতুলনীয়। খামারের হাঁসের তুলনায় বিলের হাঁস অনেক ভাল। এজন্য শহর থেকে অনেকেই এসব হাঁস কিনতে আসছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে হাঁস কিনে শহরের বাজারগুলোতে বিক্রি করছেন। আবার অনেকেই এলাকায় এসে হাঁস কিনে পিকনিক করছেন। তার মতে, হালতিবিল এখন অনেকটাই হাঁস রাজ্য। একই কথা আরো অনেকেরই।
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২৫০টি পারিবারিক ও বাণিজ্যিক হাঁসের খামার রয়েছে। এরমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করা হাঁসের খামারের সংখ্যা ২১টি। এসব হাঁসের খামারে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৩টি পাতিহাঁস ও ১০ হাজার ৮৫৫টি রাজহাঁস লালন পালন করা হয়। এছাড়া ভ্রাম্যমান হাঁসের খামার রয়েছে প্রায় শতাধিক। এসব খামারে লালন-পালন করা হয় অন্তত পাঁচ লাখ হাঁস। অন্যদিকে স্থানীয় সূত্র মতে জানা যায়, জেলার বৃহত্তম হালতিবিলের প্রতিটি বাড়িতে গড়ে অন্তত ৩০ থেকে ৫০টি করে রাজহাঁস এবং গড়ে ৪০ থেকে ৭০/৮০ টি করে পাতি হাঁস বা দেশীয় হাঁস লালন-পালন করছেন গৃহবধূরা। এতে এ বিল এলাকায় বর্ষাকালীন সময়ে কমপক্ষে ১০ লাখ হাঁস লালন-পালন হয়েছে। সেই সঙ্গে হচ্ছে উৎপাদন লক্ষাধিক ডিম। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে।
নাটোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডঃ জুলফিকার মোঃ আখতার হোসেন এতথ্য নিশ্চত করে জানান, শামুক-ঝিনুক পোকামাকড়, ভুষি ও ভাত খাওয়াতে পারলে হাঁস পালন সহজ এবং খরচও কম হয়। এতে হাঁস পালন লাভজনক হয়। আর বাড়ি বাড়ি ও পারিবারিকভাবে হাঁস পালন করা গেলে মানুষের খাদ্য তালিকায় মাংস ও ডিমেরচাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এজন্য গ্রামীণ নারীদের হাঁস-মুরগী ও গোবাদি পশু লালন-পালনে প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জেলায় ডিমের চাহিদা ১৯ কোটি ২৪ লাখ পিস। সেখানে ডিম উৎপাদন হচ্ছে ৪৫ কোটি ৭৮ লাখ পিস। যার বাজার মূল্য ৫৮৫ কোটি টাকা। হাঁস লালন-পালনের ফলে একদিকে মাংস ও ডিমের চাহিদা মেটাচ্ছে। অপরদিকে আর্থিকভাবে লাভ হচ্ছেন হাঁস লালন-পালনকারীরা। জেলায় মোট মাংসের চাহিদা এক লাখ পঁচিশ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। সেখানে মাংস উৎপাদন হয় ১ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন।
মন্তব্য করুন