ভিডিও শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

শাম্মী কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন

শাম্মী কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন

সাজেদুর আবেদীন শান্ত : পুরান ঢাকার মেয়ে শামীম আরা আজিজ শাম্মি।  অনার্সে পড়ার সময় থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এবং মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই মাত্র চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে তার উদ্যোগের কাজ শুরু করেন। অনলাইনের মাধ্যমে উদ্যোগ শুরু হলেও স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল নামে গড়ে তুলেছেন পোশাকের ব্রান্ড। বর্তমানে অনলাইন থেকেই তিনি মাসে আয় করছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

শামীম আরা আজিজ শাম্মির এগিয়ে চলা, প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন দৈনিক করতোয়া’য়।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্প: ছোটবেলা থেকেই আমি স্বাধীনভাবে চলতে পছন্দ করতাম। যে সময় বাচ্চারা পরিবারের কাছ থেকে পকেট মানি চাইতো সে সময়টাতে আমি চেষ্টা করতাম টিফিন কিংবা যাতায়াতের ভাড়া বাঁচিয়ে নিজের পকেটমানি বের করার কথা।

যখন একটু বড় হলাম বোঝার মত বয়স হলো এবং নিজে কিছু করার অনুমতি পেলাম তখন বাচ্চাদেরকে ছবি আঁকা শিখানোর কাজ শুরু করলাম। এভাবে একটু একটু করে নিজের একটা পরিচয় তৈরি করার স্বপ্ন বুনতে থাকলাম এবং ২০০২/২০০৩ এর দিকে যখন আমি অনার্সের পড়ি তখনই শুরু করলাম আমার শখের কাজ। আমি সূচিকর্ম খুব ভালোই করতে জানতাম তাই সেটা দিয়েই শুরু হল আমার উদ্যোগের যাত্রা। মার্কেট থেকে কাপড় কিনে সেখানে নানারকম নকশা এঁকে সেগুলোতে সুতার কাজ করতাম এবং নিজের আশেপাশের অন্যজনের কাছে তা বিক্রি করতে শুরু করলাম। যখন দেখলাম সবাই খুব প্রশংসা করছে তখন সেই প্রশংসাগুলো আমাকে কাজে আরও অনুপ্রাণিত করল। আর তখন আমি সূচিকর্মের পাশাপাশি ব্লক প্রিন্টের ওসব তৈরির কাজও শুরু করে দিলাম। যথারীতি এটাও আমার আশেপাশে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেল। আর এভাবেই আমার স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়ে গেল।

স্বপ্নছোঁয়া নামে যদিও এখন তা পরিবর্তন হয়ে স্বপ্ন ছোঁয়া লাইফস্টাইল নামে পরিচিত। আমার এই স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছাটা আরো প্রখর হলো যখন আমি মাস্টার্সে পড়ি তখন আমার শিক্ষকের একটা লেকচার আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেন মার্কেটিং করে যদি তোমরা ন্যূনতম একটা চায়ের দোকান খুলতে না পারো তাহলে তো সেই পড়া বৃথা। আর তখনই ভেবে বুঝলাম যে না চাকরি-বাকরি হয়তো করব কিছুটা সময় কিন্তু নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে হবেই।
যেহেতু অল্প পুঁজি তাই পড়াশোনার পার্ট চুকিয়ে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকে গেলাম। চাকরির পাশাপাশি ছোট পরিসরে আমার উদ্যোগের কাজও তখন চলছে। কিন্তু মাথায় ছিল চাকরি করে টাকা সেভ করতে হবে এবং সেই টাকা দিয়ে ভালোভাবে ব্যবসায় নামতে হবে।
পরবর্তীতে বিয়ে হল বাচ্চা হল এবং একটা সময় মনে হল যে, না আমার স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে এখন এটাকে ভালোমতো পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর তাই তখন ২০১৫ দিকে চাকরি ছেড়ে জমানো পুঁজি দিয়ে একটা কারখানা স্থাপন করে ফেললাম। কেননা আমি দেখছিলাম অন্যের জায়গা থেকে কাজ করিয়ে আনতে গেলে ডিজাইন কপি হয়ে যাচ্ছে এবং সে ক্ষেত্রে কম্পিটিশনে টিকে থাকাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে এবং খরচটাও বেশি হচ্ছে। এ কারণে আমার মনে হল যে এখন কারখানাটা স্থাপন করলে আমার জন্য এটা ভালো ফলাফল দিবে। আর কারখানা স্থাপন করার পর আমি খুচরা বিক্রির পাশাপাশি সাপ্লায়ার কিংবা হোলসেল বিক্রির জন্য খোঁজ করতে শুরু করলাম এবং পেয়েও গেলাম আলহামদুলিল্লাহ।
পোশাক নিয়ে কাজ কেনো ঃ যেহেতু আমি দেশীয় ব্লক এবং স্ক্রিনটাকে রিপ্রেজেন্ট করছি তাই আমার মনে হয়েছে মানুষের পোশাক হলো সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল এবং এটাতে যদি আমরা আমাদের এই ব্লক এবং স্কিন ú্রন্টিটাকে ব্যবহার করি তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা আরও বেশি দৃঢ় হবে এবং ব্যবহারযোগ্যতাটাও বাড়বে। বিছানার চাদর কুশন এগুলোতেও কাজ করা যায় কিন্তু এগুলো আমরা কিন্তু সচরাচর কিনি না যতটা না আমরা পোশাক পরিচ্ছদ কিনে থাকি। তাই আমার মনে হয়েছে যে আমি এই জায়গাটাতে কাজ করলে আমাদের দেশের ব্লক বাটিক স্ক্রিন এই শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কেননা পার্শ্ববর্তী দেশের ব্লক বাটিকের উপর আমাদের অনেকেরই খুব বেশি ঝোঁক রয়েছে। সেখানে আমরা যদি ভালো মানের এবং ইউনিক ডিজাইনের পোশাক তৈরি করতে পারি তাহলে অন্যদেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
সংসার সামলিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চ্যালেঞ্জ ঃ কাজ করতে গেলে আমাদের মেয়েদের আসলে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সংসার সামলে উদ্যোক্তা হওয়াটাও কিন্তু অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। বাচ্চার দেখাশোনা, রান্নাবান্না সব করে তিন নাম্বার কাজটা ছিল আমার উদ্যোগের পেছনে সময় দেওয়া। অনেক সময় দেখা যেত মেলা করব, কিন্তু বাচ্চা কোথায় থাকবে ইত্যাদি বিষয়। তো সেই সময় দেখা গিয়েছে আমার মা কিছুটা হলেও আমাকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না যে আমি কোন কাজ করি বাচ্চা-কাচ্চা ফেলে। যেটা আসলে সব না হলেও অনেক বাবা-মা’রই মনে হয়। অনেক বকা খেয়েছি তারপরও পিছিয়ে যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে সময় ছোট বাচ্চাকে নিয়েই কাজের বিভিন্ন জায়গাগুলোতে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেছি।

কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতাগুলো ঃ কাজ করতে গিয়ে আসলে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা শিকার হয়েছি এটা সত্য। কেননা এখনকার মত আমাদের সময় সবকিছু এতটা সহজলভ্য ছিল না। তখন গুগলে সার্চ দিলে সোর্সিং খুঁজে পাওয়া যেত না। র'মেটেরিয়াল, রং, কাপড় কোথা থেকে কিনলে কম দামে পাওয়া যাবে, হোলসেল কোথায় আছে, এই জিনিসগুলো আসলে আমাদের সেই সময় যারা নিজ উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেছে তাদের জন্য অনেকটাই কষ্টসাধ্য। থান কাপড়ের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হয়েছে খুঁজতে হয়েছে তারা কোথায় এগুলো বানায়। এখন মেয়েরা অনেক জায়গায় যায় এবং কেউ অন্যভাবে দেখেনা কিন্তু আমি যখন কাজ শুরু করেছি তখন আসলে মেয়েদের সব জায়গায় যাওয়াটাও একটা ব্যারিয়ার ছিল। পুরুষ হোলসেলাররা এখন অনেক সহযোগিতা করে এবং সম্মান দিয়ে কথা বলে। কিন্তু আমি যে সময় কাজ শুরু করেছি সেই সময়টাতে এভাবে সহযোগিতা ছিল না তাদের তরফ থেকেও। এখন প্রোডাক্ট বানালে বিক্রি করার জন্য অনেক জায়গা রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ই-কমার্স ইত্যাদি কিন্তু যখন আমি কাজ শুরু করেছি তখন এই সমস্ত কিছুই ছিল না তখন শুধু মাত্র মেলায় ছিল পণ্য বিক্রি করার একমাত্র মাধ্যম। এছাড়াও যেহেতু দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করছি তাই ২০১৩-১৪-এর দিকে শুরু হল ইন্ডিয়ান পাকিস্তানি কাপড়ের দৌরাত্ম্য সেই সময়টাতে আমাদের দেশীয় পণ্য নিয়ে টিকে থাকাটা অনেক দুস্কর হয়ে পড়েছিল কিন্তু তারপরও আল্লাহর রহমতে চালিয়ে যেতে পেরেছি এবং এখন পর্যন্ত টিকে আছি।

আমার পোশাকের বিশেষত্ব ঃ আমার টার্গেট কাস্টমার আসলে একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর রয়েছে। যারা একটু ভিন্ন ধরনের পোশাক পড়তে পছন্দ করেন এবং সেটা অবশ্যই আনকমন এবং ইউনিক হতে হবে। আমি আমার প্রত্যেকটা পোশাক খুব বেশি পরিমাণে তৈরি করি না যেন কমন না হয় এ কারণে। এছাড়াও রং, কাপড়ের মান অনেক ভালো দিয়ে থাকি এবং সালোয়ার কামিজের বিষয়ে যেটা বলবো- সেখানে আমার একটা সুনাম রয়েছে যেটা হল যে আমি আমার ওড়নাগুলো অনেক বড় এবং চওড়া দিয়ে থাকি যেটা সবার খুব পছন্দ। এরকম ছোটছোট অনেক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আমার পোশাক অনেকের কাছেই অনেক পছন্দের।

আরও পড়ুন

নারীদের কর্মসংস্থানে ভুমিকা ঃ যেহেতু আমি একজন মেয়ে, তাই আমি সবসময়ই চিন্তা করি যে আমার কাজের জায়গায়ও আমি মেয়েদেরকে কাজ করার সুযোগ করে দিব এবং এই ভাবনা থেকে আমার কারখানায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়ে কর্মী রয়েছে এবং আমার এখন নিজস্ব শোরুম রয়েছে যেখানে দুইজন মেয়ে বিক্রয়কর্মীও রয়েছে। পাশাপাশি আমার শোরুমে আমি আরো চারজন মহিলা উদ্যোক্তাকে তাদের পণ্য ডিসপ্লে করার জন্য ছোট্ট স্পেস শেয়ার করেছি যেখানে আমার মতই ছোট উদ্যোক্তা যারা আছে যাদের একা শোরুম দেয়ার মত অত বড় উদ্যোগ নিতে পারে না কিন্তু একটা জায়গা প্রয়োজন তাদেরকেও আমি আমার এই শোরুমে জায়গা করে দিয়েছি তাদের তৈরি নিজস্ব পূর্ণ ডিসপ্লে করার এবং বিক্রি করার জন্য।

আমার অনুপ্রেরণা ঃ আমার কাজের অনুপ্রেরণায় ছিলেন আমার বাবা। তিনি হয়তো আমাকে পুঁজি হিসেবে অর্থ কিংবা অন্যান্য কোন সুবিধা দিয়ে সাপোর্ট করতে পারেননি। কিন্তু আমি যে কাজ করছি এটা কিভাবে করছি, কি করলে ভালো হবে, হিসেব কিভাবে রাখতে হবে ইত্যাদি এমন ছোটখাটো বিষয়গুলো আমার সাথে আলোচনা করতেন। যেটা আমাকে আমার কাজকে অনেক অনেক অনুপ্রেরণা দিয়েছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঃ আমার উদ্যোগ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল আমি চাই, দেশীয় পোশাকের বাজার আরো বিস্তৃত করতে। যাতে আমাদের ভিনদেশী পোশাকের উপর নির্ভর করতে না হয় এবং দেশীয় পোশাকের ঐতিহ্য ধরে রাখতে। স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ইউনিক ডিজাইনের গুণগত মানসম্পন্ন পোশাক ক্রেতার হাতের নাগালে পৌঁছে দিবে। সুদূর ভবিষ্যতে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল এর কাঠ ব্লক, স্ক্রিন ও ফয়েল প্রিন্টের পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে। এছাড়াও স্বপ্নছোঁয়া লাইফস্টাইল এখন ছোট উদ্যোক্তাদের সাথে নিয়ে মাল্টিব্র্যান্ড শোরুম খুলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এতে। আমি যেমন স্বাবলম্বী হব আমার সাথে আরো কিছু উদ্যোক্তাকেও আমি স্বাবলম্বী করার সুযোগ করে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি কেননা শুধুমাত্র পণ্য বানালেই হবে না সেটা বিক্রি করার একটা জায়গা প্রয়োজন আর সেই জায়গা এখন স্বপ্ন ছোঁয়া লাইফস্টাইলের মাধ্যমে অন্যান্য ছোট উদ্যোক্তারাও পাবে।

 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ৫৩, মৃত্যু নেই

চীনের সঙ্গে কাজ করা আমাদের জন্য অপরিহার্য: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে জীবন দেয়নি মানুষ: উপদেষ্টা নাহিদ

জামালপুরে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে একজন নিহত

নোয়াখালীতে বিএনপিকর্মীকে গুলি করে ও গলা কেটে হত্যা

জুমার নামাজ আদায় করে বাড়ি ফেরার পথে যুবদল কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা