বর্ষবরণে আতশবাজি ও ফানুসে পরিবেশ দূষণ
কী ভীষণ শব্দে আতশবাজি! আমার ছোট্ট বাচ্চাটি এমনিতে হার্টের রোগী। আতশবাজির প্রচন্ড শব্দে আমার শিশু বাচ্চাটি ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে। খুব ভয় পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। খুবই আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সন্তানদের বুঝ দান করুক দোয়া করা ছাড়া কোন উপায় নাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাসটি ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইউসুফ নামের এক অসহায় বাবার।
এইতো গত দুই বছর আগে পুরনো বছরকে বিদায় জানাতে এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানতে পৃথিবী সেজেছিলো নতুন সাজে। চারদিকে বেজে উঠেছিলো আতশবাজির শব্দ আর আলোর ঝলকানি। সবাই মেতেছিলো আনন্দে কিন্তু কারো কারো আনন্দ যে অন্য কারো জীবনে কান্নারও হতে পারে।
ঢাকার মোহাম্মদপুরের চার মাস বয়সী শিশু উমায়ের পরিবারের কাছে সেদিন অন্যের আনন্দ বিষাদে রূপ নিয়েছিলো। আতশবাজির বাজনায় যখন সারাদেশ আনন্দের জোয়ারে ভাসছিলো তখন সেই আতশবাজির শব্দে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল চার মাস বয়সী শিশু উমায়ের।
পরের দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছিল শিশুটি। এরকম হাজারো শিশু, বৃদ্ধ, হার্টের রোগী, গর্ভবতী নারী আমাদের আশেপাশে বসবাস করে। শিশু ও প্রবীণরা আতশবাজির শব্দে হঠাৎ অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরা কে তাদের কথা ভাবছি। ভাবুন তো উমায়ের যদি আপনার পরিবারের কেউ হতো তাহলে আপনার কেমন লাগতো?
আমরা মানুষ হিসাবে নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি কিন্তু আসলেই আমরা কি সভ্য। আতশবাজির কারণে শুধু মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয় তা কিন্তু নয় পরিবেশেরও ভয়ংকর ক্ষতির সম্মুখীন হয়। থার্টি-ফাস্ট নাইটের পরের দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভিডিয়োতে আতশবাজির সময় পাখিদের অবস্থা চোখে পড়ে। আতশবাজির প্রচন্ড শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে ভয়ে তারা এদিকে সেদিকে ছুটাছুটি করে।
পাখিরা মূলত শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে যাতায়াত করে। আতশবাজির শব্দের কারণে তাদের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটে। ফলে তারা নিজেদের বাসস্থানে ফিরতে পারে না এবং অনেক পাখি আতঙ্কে নিজেদের বাসস্থান ত্যাগ করে। এদিক সেদিক ছুটাছুটির সময় শব্দ দূষণের ফলে শব্দ দ্বারা সঠিক পথ নির্ণয় করতে পারে না ফলে বৈদ্যুতিক খুটি বিভিন্ন দেওয়াল এবং স্থাপনার সাথে আঘাত পেয়ে অনেক পাখি মারা যায়।
অতিরিক্ত শব্দে পাখিদের স্বাভাবিক জীবন ক্রিয়া ব্যাহত হয়। গণমাধ্যমের তথ্য মতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর বর্ষবরণের রাতে শব্দ ও বায়ুদূষণে রাজধানীতে শতাধিক পাখির মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে ইতালির রোম শহরে থার্টি ফার্স্ট নাইটে উদযাপনে আতশবাজির শব্দে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিলো। এই পাখিগুলো আতশবাজির তীব্র শব্দে হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল।
পুলিশের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে আতশবাজি এবং ফানুস থেকে সারাদেশে প্রায় ২০০ জায়গায় আগুন লাগে। এই অগ্নিকান্ডের উৎস ছিলো ফানুস ও আতশবাজি। ফানুসের আগুনগুলো বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনায় গিয়ে পড়ছে সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটছে। আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি ফানুসের আগুনগুলো তেল পাম্প, বৈদ্যুতিক তার, ট্রান্সমিটার, বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানার উপরে গিয়ে পড়লে কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের অসাবধানতার কারণে ঘটতে পারে অনেক বড় দুর্ঘটনা।
আরও পড়ুনআতশবাজির কারণে অতিরিক্ত শব্দ, পশুপাখি, মানুষের ক্ষতি সহ আমাদের চারপাশে পরিবেশও ধ্বংস করে ফেলছি। আতশবাজিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর ক্যামিক্যালগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের বায়ু দূষিত করছে। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডায়েচ ভেলের প্রতিবেদন অনুসারে, থার্টি-ফাস্ট নাইট উদযাপনের কারণে যে পরিমাণ ধোঁয়া উৎপন্ন হয় তা একবছরে যানবাহন কর্তৃক উৎপন্ন ধোয়ার সমান। আতশবাজির কারণে ধাতব মৌলগুলো বাতাস, পানি ও মাটিতে মিশে বিষাক্ত করে তুলছে। ২০২৪ সালে বছরের প্রথম দিন ১০৯টি শহরের মধ্যে বায়ু দূষণের শীর্ষে ছিলো ঢাকা। আইকিউ এয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ছিলো ২৪৬। যেটিকে খুব অস্বাস্থ্যকর হিসাবে ধরা হয়।
প্রতিবছর থার্টি-ফার্স্ট নাইট উদযাপনে আতশবাজি এবং ফানুস উড়ানো তে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি শুধু কাগজে কলমে থাকে। যার প্রতিফলন আমরা মাঠ পর্যায়ে দেখতে পাই না। শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নয় সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমাদের উচিত অতিরঞ্জিত উদযাপন থেকে বিরত থাকা যা আমাদের নিজেদের এবং পরিবেশের জন্য ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়। উদযাপন ভারসাম্য নিয়ে আসা। নিজে বিরত থাকা এবং আশেপাশে মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করা।
আমাদের আশেপাশে কত মানুষ শীতে নিজেদের কাপড় কিনতে পারছে না। কত পথশিশু শীতে রাস্তায় থর থর করে কাঁপছে। আমরা অযথা সাময়িক আনন্দের জন্য আতশবাজি ফাটিয়ে ও ফানুস উড়িয়ে টাকা নষ্ট না করে সে সমস্ত টাকা শীতার্তদের সহযোগিতা করতে পারি। তাহলে ইহকালে আমরা পরিবেশ ধ্বংস থেকে বিরত থাকতে পারবো এবং পরকালের জন্য পূণ্য সঞ্চয় করতে পারবো।
আসুন আমরা মানবিকতার পরিচয় দেই এবং দায়িত্ববান আচরণ করি। বছরের প্রথম সূর্যোদয় নিকষ কালো আঁধারে আচ্ছন্ন না হোক। আশেপাশে পড়ে না থাকুক শত শত মৃত্যু পাখি এবং অন্য ক্ষুদ্র জীবজন্তু। আমাদের মাঝে জাগ্রত হোক অপরাধ বোধ। আমরা শুধু কথায় মানুষ না হয়ে আমাদের কাজে মনুষ্যত্বের প্রতিফলন ঘটুক।
মো: রুহুল আমিন
লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
মন্তব্য করুন