নদী বাঁচাও, দেশ বাঁচাও
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশে জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাম না জানা অসংখ্য নদ- নদী। বাংলাদেশে নদ নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নদ নদীর সংখ্যা ৭০০টি। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে বাংলাদেশে মোট নদ নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। ২০২৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ছোট-বড় ১০০৮টি নদ নদীর তালিকা তৈরি করে।
সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলে পৃথিবীতে এত নদীবিধৌত দেশ দ্বিতীয় আরেকটি নেই। কবি অতুল প্রসাদ সেন এর মতে এদেশ তেরশত নদীর দেশ। মূলত নদীমাতৃক বাংলার নদ- নদী'র আধিক্যতা বোঝাতেই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলার পূর্বের সেই রূপ আর নেই। নানাবিধ কারণে নদীগুলো আজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
একসময় ছিল যখন নদী ছিল বাংলার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। নদীকে কেন্দ্র করে যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালিত হত। পৃথিবীর যত বড় বড় সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সবগুলোই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মূলত নদী পথে যোগাযোগের সহজলভ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নদীর তীরে সভ্যতা, হাট বাজার, নগর গড়ে উঠতো। প্রত্যেক বছর বন্যায় নদীর অববাহিকায় বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বয়ে নিয়ে আসে।
যা জমির উর্বরা শক্তিকে বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমি নদীর পলিমাটি অববাহিকা দ্বারা গঠিত। এদেশের বুক চিরে ২৪১০০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অসংখ্য নদ নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর পানির সহজলভ্য সেচ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে ফসল আবাদ হয়। যা ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমায়।
বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ নদীপথে যাতায়াত করে। যা মোট যাত্রী পরিবহনের এক চতুর্থাংশ। দক্ষিণাঞ্চলের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম নদীপথ। নদীতে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়। যা জেলে সম্প্রদায়ের জীবিকার প্রধান উপজীব্য। মাছে ভাতে বাঙালির মাছ আমিষের প্রধান উৎস। যার অনেকাংশে নদীগুলো থেকে আসে। জিডিপির ৩.৬৭ শতাংশ আসে মংস্য খাত থেকে। শতকরা ৬০ শতাংশ মানুষ খাদ্যের জন্য নদীর উপর নির্ভরশীল। মানুষের কল্যাণে নদী তার সর্বত্র বিলিয়ে দিলেও কেউ তার এই উপকার স্বীকার করতে রাজি নই।
প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অজুহাতে নদীশাসন চলছে। নদীর দুই তীরে চলছে কল কারখানা নির্মাণের মহা উৎসব। এসব কল-কারখানা হতে নির্গত বর্জ্য পদার্থ সরাসরি নদীর পানিতে পতিত হয়। যা নদীর পানিকে দূষিত করে। নদীকে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গঞ্জ - নগর গড়ে উঠছে। যার অধিকাংশ পরিকল্পনা বিহীন। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে নদীগুলো আজ হুমকির সম্মুখীন।
এছাড়া নদীতে বড় বড় জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করে। এসব জাহাজ, লঞ্চ থেকে নির্গত তেল জাতীয় পদার্থ ও বর্জ্য নদী দূষণের অন্যতম কারণ। শহরের আবর্জনা - বর্জ্য পদার্থগুলো অধিকাংশ সময় নদীর তীরে অপসারণ করা হয়। অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট আবর্জনা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ড্রেন, নালা, নর্দমা, খাল বিলের মাধ্যমে নদীতে পতিত হয়। ফলে নদীগুলো তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
তাছাড়া নদী ভরাট করে জায়গা দখল করার প্রতিযোগিতা তো আছেই। প্রভাবশালী মহল নদীর দুই তীর ভরাট করে ভবন, মার্কেট, শপিং মল গড়ে তুলছে। ফলে নদীগুলো ক্রমশ সরু হয়ে আসছে। একসময় পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে নদীগুলো মারা যায়। নদীর বুক থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের ফলে দুই তীরে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুননদী ভাঙনের কবলে সর্বস্বান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন জীবন - যাপন করছে। তাছাড়া ভারতের সাথে আমাদের ৫৪টি আন্তঃসংযোগ নদী রয়েছে। ভারত সরকার কর্তৃক নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। দীর্ঘদিন নদীগুলো ড্রেজিং না করায়, নদীর বুকে চর জেগে উঠে। যা পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। একসময় মরা নদীতে পরিণত হয়। এভাবে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অজুহাতে নদীশাসন চলছে। ইতিমধ্যে অনেক ছোট নদী মৃত নদীতে পরিণত হয়ে গেছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে তুলতে হবে। শহরের বর্জ্য পদার্থগুলো নদীর তীরে না ফেলে লোকালয় থেকে দূরে একটি নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নিয়মিত ড্রেজিং করতে হবে। অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। যারা অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
ভাঙন প্রতিরোধে নদীর দুইপাশে টেকসই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আন্তঃসংযোগ নদীগুলোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুসারে নদীর পানি বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টি সরকারী পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তি পর্যায়েও এগিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই নদীমাতৃক বাংলার চিরচেনা রূপ ফিরে পাবে।
সবুজ আহমেদ জীবন
লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
01723-263211
মন্তব্য করুন