ভ্যাট-শুল্কের চাপ নয়
দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে এমনিতেই মানুষের নাভিশ্বাস, তার উপর শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যবসায়িক সংগঠন। গত শনিবার তারা সমাবেশ বিবৃতি ও আলোচনায় এ প্রতিক্রিয়া জানান। তাদের মতে, মানুষের পেটে যদি ক্ষুধার আগুন থাকে, তাহলে তারা সংস্কারের কথা শুনবে না।
আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের উপর ভ্যাট বৃদ্ধি ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে। তারা আরো বলেন, মূল্যস্ফীতি যখন প্রচন্ড আকার ধারণ করেছে তখন এমন ধরনের কর বাড়ানো দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের জীবনযাত্রাকে আরো কঠিন করে তুলবে।
গলদঘর্ম খেটেও পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করতে পারছে না অনেকে। মূল্যস্ফীতির চাপে জীবন যাপন নিয়ে যখন তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা, তখনই নতুন করে ভ্যাট-ট্যাক্সের খড়গ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান যখন বেড়েই চলছে, তখন এই সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী বলে এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে মাছ, মাংস-সবকিছুতেই দাম বাড়ানোর যে প্রতিযোগিতা, তাতে সাধারণ মানুষের খেয়ে -পরে টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন সংকটের মধ্যেই নতুন করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্সের জেরে জীবন যাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়বে বলে আশংকা করছেন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলেন, শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি কমবে। মনে হলো এই ১২ হাজার কোটি টাকা মানুষের পকেট থেকে যাবে। যদিও ৫ জানুয়ারি এনবিআর এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, নতুন করে যেসব পণ্য ও সেবার শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে, সেখানে নিত্য পণ্য নেই। এতে সর্বসাধারণের ভোগ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবেনা, মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।
যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুঠোফোন সেবা, ইন্টারনেট, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, পোশাক, রেস্তোরাঁয় খাবার ইত্যাদি এখন জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ। নতুন করে শুল্ক-কর বৃদ্ধি মধ্যম ও নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়াবে। এ ছাড়া অনেক পণ্য ও সেবার আগে থেকেই উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। সেগুলোর ওপর কর বাড়ানোর যৌক্তিতা নেই।
পত্র-পত্রিকার খবরে বলা হয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়েও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা সহ ৬৭ পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর)। এ ছাড়া বার্ষিক টার্নওভারের সীমা কমিয়ে আনায় খড়গ নেমে আসবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়।
আরও পড়ুনশতাধিক পণ্যে শুল্ক ও কর হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ। গত শনিবার ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। পরে সংগঠনটির দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
যার মূল কারণ হলো, সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতাসহ উচ্চ সুদহার। তা ছাড়া বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু পণ্যের কর হার বৃদ্ধি এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
আমন ধান ওঠার পরও চালের দাম কেজি প্রতি দশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর ওপর এবারে মোবাইল ফোন সেবা, ইন্টারনেট সেবা, রেস্তোরাঁয় খাবার খরচ বাড়বে। মূল্য বৃদ্ধির তালিকায় আরও রয়েছে মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, সফট ড্রিংকস, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম ইত্যাদি নানা পণ্য। মোবাইল ও ইন্টারনেট খরচের আওতায় রয়েছে দেশের প্রায় সব নাগরিক। খাদ্য ও ওষুধের দাম বাড়ার ফলে সবারই প্রাত্যহিক খরচ বাড়বে। গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের ব্যয় বাড়বে।
জীবনযাত্রায় খরচের ফাঁদে পড়বে সাধারণ মানুষ। এ জন্য ভ্যাট ও করের হার না বাড়িয়ে বিকল্প উৎস থেকে কর সংগ্রহের কথা বলেন কেউ কেউ। অতএব, সুচিন্তিত গণবান্ধব ও কল্যাণকর উদ্যোগ নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।
মন্তব্য করুন