মরণঘাতী বায়ু দূষণ
রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ কিছুতেই কমছে না। প্রতিদিনই দূষণ বেড়ে ঢাকার বাতাস এখন চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় পৌঁছেছে। বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকা প্রায় প্রতিদিনই শীর্ষ অবস্থানে থাকছে। শুধু বর্তমান সময়ই নয়, গত দুই দশক ধরে বায়ু দূষণ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীবাসী। বায়ু দূষণের কারণে এই সময়টায় শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত হন মানুষ। জানা যায়, এ সময়টায় উত্তরের হিমেল বাতাস প্রবাহিত হয়।
তখন বিষাক্ত বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এ ছাড়া বায়ু দূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে ক্যান্সার, অ্যাজমা, অ্যালার্জিসহ বিভিন্ন চর্মরোগ বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন শিশু এবং বয়স্করা। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার বায়ু দূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় শহরের স্বীকৃতি পায় রাজধানী ঢাকা।
এ ছাড়া সপ্তাহের শুরু থেকেই বায়ু দূষণে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ মূলত যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) এর তথ্যে দিনের বেশির ভাগ সময় ঢাকার দূষণের স্কোর ছিল ১৯০। যার অর্থ হচ্ছে এ শহরের বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং এ অবস্থায়, শহরের সবাই বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে বায়ু দূষিত হচ্ছে। রাজধানীতে নির্মাণ কাজ হয়, যা ধূলা তৈরি করছে। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ, আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা, ইটভাটা থেকে শুরু করে কোনোটাই নিয়ম মেনে করা হয় না। বাতাসে যে পরিমাণ সালফার ভাই অক্সাইড থাকে তা পানিতে মিশে চোখে জ্বালাপোড়া করায়। এতে ফুসফুসের প্রদাহ থেকে শুরু করে অনেক ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা যায়। এ ছাড়া বাতাসে ধুলিকণা আছে তার মধ্যে পিএম-২ দশমিক-৫ এর নিচে যেসব উপাদান সেগুলোই সবচেয়ে ক্ষতিকর। আইনের প্রয়োগ না থাকায় ঢাকার দূষণ এখন অতিমাত্রায় দৃশ্যমান।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের ‘ব্রেদিং হেভি; নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ, শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক কিছু তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণে সৃষ্ট রোগে বছরে বাংলাদেশে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। একই সঙ্গে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩ দশমিক ৯ থেকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে।
আরও পড়ুনসুইজারল্যান্ড ভিত্তিক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার এয়ার ভিজুয়াল এবং নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিনপিস’ ২০১৮ সালে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল, যেখানে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ৭৩ দেশের মধ্যে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। অন্যদিকে দূষিত শহর হিসেবে ১৭তম। তালিকাটি প্রস্তুত করতে বাতাসে পিএমটু পয়েন্ট ফাইভ নামে পরিচিত এক ধরনের সূক্ষ্ম কণার উপস্থিতির মাত্রা পরিমাপ করা হয়েছিল, যাতে দেখা গেছে বাংলাদেশের বাতাসে পিএমটু পয়েন্ট ফাইভের গড়মাত্রা ৯৭ দশমিক ১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিএমটু পয়েন্ট ফাইভের দূষণে ফুসফুসের ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদরোগ এবং শ্বাসযন্ত্রের রোগ হতে পারে, যার মধ্যে অ্যাজমা অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অকালে প্রাণহানির জন্য দায়ী কারণগুলোর মধ্যে চতুর্থ হচ্ছে বায়ু দূষণ। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বে অন্তত ৭০ লাখ মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। আর এ জন্য বিশ্বে বার্ষিক প্রায় ১৯ লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর কোটি কোটি গাছের চারা রোপণ করার পরও জাতিসংঘ বলছে, গত ১০ বছরে বিশ্বে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ হেক্টর বনভূমি।
এ হিসাবে প্রতি মিনিটে ধ্বংস হচ্ছে প্রায় আট হেক্টর বনভূমি। যে হারে পৃথিবীতে বন উজাড় হচ্ছে, সে হারে বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশে গড়ে ২৪ ঘন্টায় ১ লাখ ৩০ হাজার বৃক্ষ নিধন হলেও রোপণ হচ্ছে মাত্র ৩০ হাজার। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর কী নিষ্ঠুর আচরণ করছি আমরা। মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি।
এ জন্য বায়ু দূষণের কারণগুলো রাজধানীসহ সারা দেশের পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এ প্রতিষ্ঠান বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, এটাই প্রত্যাশা।
মন্তব্য করুন