প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন
‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ এমন একটি শব্দ যা আজকের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য মর্যাদার প্রতীক। এরা প্রবাসী বাংলাদেশি, যারা নিজেদের পরিবার এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদেশে পরিশ্রম করে থাকেন। তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং ত্যাগের ফলে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ গড়ে তুলেছে, তা আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসেবে কাজ করছে।
এই প্রবাসীরা যদি দেশের অর্থনীতিতে অবদান না রাখতেন, তাহলে আরও অনেক আগেই আমাদের দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। কারণ বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতারা আর আমলারা দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। গড়ে পাচার হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। দেশের এই দুরবস্থা থেকে দেশকে যারা রক্ষা করেছে। তারা হলো প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা।
করোনাকালীন সময় যখন পুরো বিশ্ব ভয়, আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে লকডাউনে বন্দি ছিল, তখনও বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের উপার্জিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে ২০২০-২১ অর্থবছরে। করোনাভাইরাস-সৃষ্ট দুর্যোগের ওই বছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছিলেন। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়াও করোনার পরবর্তী সময়গুলোতেও প্রবাসীরা প্রতিনিয়ত দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অবদান রেখে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে যাদের এত অবদান, আমরা কি এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দিতে পেরেছি? রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিদেশে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেন, তা ভাবা অত্যন্ত প্রয়োজন। তারা নিজের পরিবার, স্বজন, এমনকি জন্মভূমি ছেড়ে সম্পূর্ণ অচেনা পরিবেশে কাজ করেন। অনেক সময় প্রতিকূল আবহাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হন। তাদের অধিকাংশই নিম্নবেতনের কাজ করেন, কিন্তু সেসব আয় থেকেই তারা নিজেদের পরিবার এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখেন।
তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দেশে এবং বিদেশে তারা প্রায়শই অবহেলিত হন। প্রবাসে অনেক শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে হয়রানি এবং শোষণের শিকার হন। চাকরির চুক্তিতে প্রতারণা, নিম্নমানের আবাসন, এবং স্বাস্থ্যের অবনতি—এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তারা দিনযাপন করেন। দেশে ফেরার পরও তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়শই উদাসীন। বিমানবন্দরে হয়রানি, ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় জটিলতা, এবং পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে মূল্যায়নের অভাব তাদের মনোবলকে দুর্বল করে দেয়।
রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের জন্য আমাদের অনেক করণীয় রয়েছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের অধিকতর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের সঠিক চুক্তির আওতায় কাজ করার নিশ্চয়তা এবং আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, দেশে ফেরার সময় তাদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও মানবিক সেবা ব্যবস্থা থাকা জরুরি। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ব্যাংকিং প্রক্রিয়া পর্যন্ত সবখানে তাদের সেবা সহজ ও সম্মানজনক করতে হবে।
যদিও প্রবাসীদের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে ভিআইপি লাউঞ্জ উদ্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু সেটি যথেষ্ট নয়। প্রবাসীদের সাথে বিমানবন্দরে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের যথাযথ সম্মানের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, তাদের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার। অনেক রেমিট্যান্স যোদ্ধা দেশে ফিরে টেকসই আয়ের পথ খুঁজে পান না। তাদের জন্য বিশেষ ঋণসুবিধা, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসায়িক সহায়তা দেওয়া গেলে তারা দেশেই কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলতে পারবেন।
আরও পড়ুনসবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের শুধুমাত্র প্রবাসী শ্রমিক নয়, বরং দেশের উন্নয়নের অন্যতম কান্ডারি হিসেবে দেখতে হবে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, সম্মান জানানো এবং তাদের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা শুধু অর্থ উপার্জনই করেন না, তারা দেশের মানুষের জীবনের মান উন্নত করার জন্য নিজেদের জীবনও উৎসর্গ করেন।
নিজের আপনজন, পরিবার-পরিজন ছেড়ে বছরের পর বছর দূর প্রবাসে অবস্থান করেন। অনেকেই জীবনের শেষ মুহূর্তে পরিবারের সংস্পর্শ ছাড়াই পৃথিবী ত্যাগ করেন। গত ৩১ বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীর লাশ এসেছে ৫৩ হাজার ৬৩৩টি। তাই, এই প্রবাসী যোদ্ধাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান কেবল ন্যায়সঙ্গত নয়, এটি আমাদের জাতীয় উন্নয়নের পথ সুগম করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আসুন, আমরা সবাই মিলে তাদের পাশে দাঁড়াই এবং তাদের প্রতি আমাদের ঋণ স্বীকার করি। তাদের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে আসীন করি।
নুরুন্নবী সোহান
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন