ভিডিও বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

গণপিটুনি সংস্কৃতির শেষ কোথায়!

গণপিটুনি সংস্কৃতির শেষ কোথায়! প্রতীকী ছবি

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে এক নির্মম ও পৈশাচিক কর্মকান্ড প্রতিনিয়তই বিস্তার লাভ করছে , যার নাম গণপিটুনি। গণপিটুনি এক নীরব সন্ত্রাসের নাম, যেখানে ন্যায়বিচারের নামে নৃশংসতাকে বৈধতা দেওয়া হয়। আইন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ন্যায়বিচার পিছু হটে, আর এক মুহূর্তেই বিচারকের আসনে বসে পড়ে উত্তেজিত ভিড়। শুরু হয় লাঠির ঘা, পাথরের আঘাত এক পর্যায়ে রক্তাক্ত মাটিতে গড়িয়ে পরে এক নির্জীব শরীর এরই নাম গণপিটুনি।

যেখানে সন্দেহই চূড়ান্ত প্রমাণ, আর প্রতিশোধই একমাত্র রায়। মূলত গণপিটুনি এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং সমাজের অন্তর্গত ক্রোধ, হতাশা এবং আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ। এই সহিংস মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং আইনের শাসনের বিরোধী। যে সমাজে মানুষের ক্ষেত্রে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ন্যায়বিচারের বিকল্প হয়ে ওঠে, সেখানে মানবতার অবক্ষয় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মূলত গণপিটুনির মূল কারণ লুকিয়ে আছে ভয় এবং প্রতিহিংসা নামক দুটি মনস্তাত্বিক স্তরের গহীনে। সমাজে যখন ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ দুর্বোধ্য ও অসম্ভব মনে হয়, তখন আইনহীনতার অন্ধকারে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে বিচারব্যবস্থা অকার্যকর। আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মুক্তি পেয়ে যাবে, আইনের ফাঁকফোকরে লুকিয়ে থেকে অপরাধীরা দিব্যি সুন্দর জীবন যাপন করবে। ফলে জনতার মনে জমে ওঠে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, যা ক্ষুদ্রতম সন্দেহের বশে মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরিত হয়।

তার পাশাপাশি বর্তমান সময়ে গণপিটুনিকে আরো উসকে দিচ্ছে সামাজিক মিডিয়া এবং গুজব।আজকের যুগে ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে। ফলশ্রুতিতে একটি সামান্য সন্দেহ বা ভুল তথ্য নিমিষেই রূপ নেয় ভয়াবহ আক্রোশে এবং সবচেয়ে ভয়ানক দিক হলো অনেক সময় শুধুমাত্র সন্দেহের বসে নিরপরাধ মানুষও গণপিটুনির শিকার হচ্ছেন। গত সাত মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন এবং এই সময়ে গণপিটুনির সংখ্যাও বেড়েছে পূর্বের তুলনায় প্রায় চার গুণ। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।

বর্তমানে সন্দেহভাজন অপরাধীকে পিটিয়ে হত্যা করলেই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গেঁথে গেছে। যা গণপিটুনির মত ঘটনাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। গণপিটুনি আসলে একটি “ক্রাউড মেন্টালিটি” বা ভিড় মানসিকতার এক ভয়ঙ্কর রূপ। একক ব্যক্তি হয়তো হত্যার কথা চিন্তাও করে না, কিন্তু যখন সে একটি উত্তেজিত জনতার মধ্যে মিশে যায়, তখন তার নৈতিকতার লাগাম ছিঁড়ে যায়,মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়, আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধা নষ্ট হয়।

এক অদ্ভুত পৈশাচিক শক্তি তাকে ধাক্কা দেয়, তার ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা হিংস্র প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলে এমন ভয়ংকর কাজে লিপ্ত হতে। পাশাপাশি গণপিটুনির নেপথ্যে আছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। তাই গণপিটুনির মতো ঘটনাগুলি ঠেকানোর জন্য আইন এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। তার জন্য বিচারব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আইনের শাসন সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রমাণ সংগ্রহের কাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।

যাতে তারা অপরাধের সঠিক প্রমাণ দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগাড় করতে পারে এবং দ্রুত শাস্তি প্রদান করতে সক্ষম হয়। প্রয়োজন বোধে বিচার কার্যকে আরো গতিশীল করতে ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় গুজব প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রোধে কঠোর মনিটরিং এর জন্য টিম গঠন করতে হবে।অপরাধমূলক তথ্য ছড়ানো, বিশেষ করে সহিংসতাকে উসকে দেওয়া পোস্টগুলোর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

আরও পড়ুন

যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আর সত্যতা যাচাই না করে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকেন। অপরাধীদের রাজনৈতিক আশ্রয় বন্ধ করতে হবে। আইন সবার জন্য সমান এই বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করা ছাড়া গণপিটুনি বন্ধ করা অসম্ভব। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুল, কলেজ ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে গণসচেতনতার বিকল্প নেই। জনতাকে বোঝাতে হবে, বিচার নিজ হাতে তুলে নেওয়াটাও অপরাধ। একজনের অপরাধ ঠেকাতে গিয়ে নিজেরা আবার অপরাধ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। এটি সমাজের জন্য কোন ভালো বার্তা বহন তো করেই না বরং এটি আরও বিশৃঙ্খলা ডেকে আনে।

সর্বোপরি, গণপিটুনির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী, মানবিক এবং আইনি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সবাই বিশ্বাস করবে যে, একজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার একমাত্র পথ হলো ন্যায়বিচার, যা আদালত এবং আইন অনুযায়ী হতে হবে।গণপিটুনি কেবল অপরাধ দমনের বিকৃত প্রতিক্রিয়া নয়,এটি আইন,রাষ্ট্র ও সমাজের যৌথ ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। আর আইন ব্যর্থ হলে সমাজও ব্যর্থ হয়। গণপিটুনির প্রতিটি আঘাত তাই কেবল ব্যক্তিকে হত্যা করে না ,সেই আঘাত রাষ্ট্রের হৃদয়েও আঘাত হানে।

বিচারের নামে রক্তপাত কখনোই শান্তি আনতে পারে না। যদি রাষ্ট্র আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়, বিচারব্যবস্থা সংস্কার না হয়, আর জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পথ বেছে নেয় তাহলে এ জাতির সামগ্রিক সামাজিক স্থিতিশীলতা এক নির্মম ধ্বংসের পথে এগোবে।রক্ত দিয়ে রক্তের বিচার হয় না। আইন-শৃঙ্খলার শেকড় মজবুত না হলে গণপিটুনি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। রাষ্ট্রের এখনই জেগে ওঠা দরকার কারণ নইলে এই সহিংসতা কেবল বাড়তেই থাকবে।

গণপিটুনির মতো এমন একটি সমস্যাকে রোধ করা শুধুমাত্র সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয় বরং সমাজের সকলের সচেতনতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধায় রেখে দোষীকে আইনের হাতে তুলে দেওয়ার মাধ্যমে গণপিটুনির মতো এমন একটি সমস্যাকে রোধ করা সম্ভব। তাই রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গণপিটুনির বিরুদ্ধে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে এবং একটি ন্যায় বিচারপূর্ণ ও মানবিক সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

 

প্রজ্ঞা দাস
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ 
ইডেন মহিলা কলেজ 

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বগুড়ার শাজাহানপুর ভূমি অফিস পরিদর্শন করলেন জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা

প্রথম একসঙ্গে ‘ইত্যাদি’র মঞ্চে হাবিব-প্রীতম

আইপিএলের প্রথম পর্বে নেই ১১ কোটি রুপির গতিতারকা

সিনেমায় নয়, এখন নাটকেই বেশি ব্যস্ত সারা জেরিন

বগুড়ার শেরপুরে চোরচক্রের ২ সদস্য গ্রেফতার : ২৯টি  ব্যাটারি ও ১০৫টি গ্যাস সিলিন্ডার উদ্ধার

কাবাডিতে ব্রোঞ্জ জয়ি মেয়েদের জন্য ক্রীড়া উপদেষ্টার অনুদান