বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন
দেশে প্রতিদিন ২৮, আর বগুড়ায় একজন করে আত্মহত্যা করে

নাসিমা সুলতানা ছুটু : বিষন্নতাজনিতসহ নানা কারণে বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। আর বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে আত্মহত্যা করে ২৮ জন। এছাড়া বগুড়ায় গত তিন বছরে এক হাজার ১৬২ জন আত্মহত্যা করেছে। অর্থাৎ বগুড়ায় প্রতিদিন একজন আত্মহত্যা করছে। বগুড়ায় আত্মহত্যার কারণ, পরিণাম ও প্রতিকারে ‘আমাদের করণীয় শীর্ষক’ এক সেমিনারের মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বগুড়া জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আজ রোববার (১৬ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেজবাউল করিমের সঞ্চালনায় সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোস্তফা মঞ্জুর, জেলা সিভিল সার্জন ডা. একেএম মোফাখখারুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক ডা. মিজানুর রহমান।
ডা. মিজানুর রহমানের ওই প্রবন্ধে আরও উঠে এসেছে, গত ৫০ বছরে বিশ্বে আত্মহত্যার হার ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো, আত্মহত্যা। ওই স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভুগছেন। গত ১০ বছরে বিশ্বব্যাপী এই রোগের ব্যাপকতা বেড়ে ১৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্সের ২০১৩ সালের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করে, প্রতি লাখে করে ৭ দশমিত ৩ শতাংশ। এদের অধিকাংশই ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারী। বিশ্বে প্রতিবছর যত মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে তার মধ্যে ২ দশমিক ০৬ শতাংশই বাংলাদেশি। আর দেশে প্রতি বছর লাখে ১২৮ দশমিক ০৮ জন আত্মহত্যা করে।
ডা. মিজানুরের ওই প্রবন্ধে পুলিশের দেওয়া তথ্যানুয়ায়ী উঠে এসেছে, বগুড়ায় আত্মহত্যা ও সামাজিক অপরাধ প্রবণতা উদ্বেগজনক। জেলায় ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৮ মাসে আত্মহত্যা করেছে ১ হাজার ১৬২ জন। এরমধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মহত্যা করেছে ৫৫ জন। এছাড়া ২০২৪ সালে করেছে ৩৩৫ জন।
আরও পড়ুন২০২৩ সালে করেছে ৩৮৭ জন এবং ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেছে ৩৮৫ জন। আতঙ্কিত বিষয় হলো বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতি বছর এই সংখ্যা বাড়ছেই। বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক সমস্যায় আত্মহত্যা করে ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। এছাড়া বৈবাহিক সমস্যায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, হৃদয়ঘটিত কারণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বিবাহ বহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্কের কারণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, স্বামীর নির্যাতনে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, আর্থিক কারণে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ আত্মহত্যার চেষ্টা করে।
যারা আত্মহত্যা করে তাদের ৯৫ ভাগই মানসিক রোগী। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই কোটি মানসিক রোগী রয়েছেন। সে অনুযায়ী দেশে মানসিক রোগের চিকিৎসক নেই। দেশে ১৫ লাখ লোকের জন্য মাত্র একজন করে মানসিক রোগী রয়েছেন। আর প্রতি ১ লাখ লোকের জন্য একটিরও কম মনোরোগ শয্যা রয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
অপরদিকে সেমিনারে বক্তারা বলেন, মনো-সামজিক সমস্যার কারণে দেশে আত্মহত্যা বাড়ছে। সবাই অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছেন এইজন্য সমস্যা তীব্রতর হচ্ছে। কর্মজীবী বাবা-মা’রা তাদের সন্তানদের সেভাবে সময় দেন না। সবকিছুই এখন ডিভাইস নির্ভর হয়ে গেছে। এটিও একটি কারণ। ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক দুটোরই বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত গভীর ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছেন। এছাড়া সমাজে নানা অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। এ থেকে বের হয়ে আসতে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।
এজন্য সবার আগে সচেতন হতে হবে পরিবারকে। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদে-মসজিদে আত্মহত্যার ধর্মীয় ও সামাজিক কুফল সম্পর্কে বুঝাতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বক্তারা বলেন, এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি স্পর্শকাতর। তাদের এমন কোন কথা বলা যাবে না, যা বুলিংয়ের পর্যায়ে যায়।
পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। এছাড়া বেসরকারি সংস্থাগুলো উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে নারীদের আত্মহত্যা না করতে সচেতন করে তুলতে পারে। সেমিনার থেকে বক্তারা দাবি তোলেন, বগুড়ায় মানসিক রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি, সে তুলনায় চিকিৎসক অপ্রতুল প্রয়োজন আরও বেশি সংখ্যক মানসিক রোগের চিকিৎসক। সেমিনারে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য করুন