ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব, করণীয় ও বর্জনীয়

ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব : পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্নধর্মী। অন্যান্য জাতি-ধর্মের উৎসব হলো খাও দাও ফুর্তি কর। তাদের আনন্দ উৎসব অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ভরপুর।
ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসরই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো-রমাদান শেষে সাদাকাতুল ফিতর গরিবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অসচ্ছল পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ঈদ যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
মুসলমানদের ঈদের পরকালীন তাৎপর্য হলো-আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রমাদান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিল করা হয়েছে। দিনে রোজা রাখার এবং রাত্রিকালীন ইবাদতের মধ্যে অনেক ফজিলতের কথা বিধৃত হয়েছে। লাইলাতুল কদর নামক হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি মহিমান্বিত রাত দান করা হয়েছে এ মাসে। পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় রমাদান মাসে। এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা। কাজেই ঈদ নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এটি একটি ফজিলতপূর্ণ ইবাদত।
‘ঈদুল ফিতর’ মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতে পরিণত হবে তাদের জন্য যারা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে রমাদানের রোজা পালন করেছে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে উদ্দেশ্যে রমাদানের রোজা ফরয করেছেন সেই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে রোজা রেখেছেন তথা তাকওয়া অর্জন করেছেন।
যারা পাপমুক্ত জীবন গঠনের মানসিকতা অর্জন করেছে এবং যারা ইসলামের নির্দেশনার গন্ডির মধ্যে থেকে আনন্দ উৎসব পালন করেছে অর্থাৎ যাদের আনন্দ উৎসবে অশ্ললীলতা ও বেহায়াপনা নেই। প্রকৃতপক্ষে এ ঈদ হলো এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। পরবর্তী এগারো মাস সেই প্রশিক্ষণ অনুযায়ী জীবনের বাঁকে বাঁকে চলার এক সফল প্রতিশ্রুতি। তাই একদিকে ‘ঈদুল’ ফিতর যেমন সিয়াম সাধনার সমাপ্তি ঘোষণা করে, অপর দিকে তা নির্মল আনন্দ বয়ে আনে।
ঈদের দিনের সুন্নাত ও মুস্তাহাবসমূহ : ঈদুল ফিতরের দিন নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পাদন করা মুস্তাহাব।
১. নিজ মহল্লার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করা।
২. মিসওয়াক করা।
৩. গোসল করা।
৪. খুশবু ব্যবহার করা।
৫. সাদাকাতুল ফিতর নামাজের পূর্বেই আদায় করা।
৬. সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা।
৭. খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা।
৮. ঈদের ময়দানে যাওয়ার পূর্বে কিছু নাশতা করা।
৯. মিষ্টি জাতীয় ও বিজোড় সংখ্যার খেজুর দিয়ে এই নাশতা করা।
আরও পড়ুন১০. সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দান সাদাকা করা।
১১. আগে ভাগে ঈদগাহে যাওয়া।
১২. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।
১৩. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া এবং অপর পথে ফিরে আসা।
১৪. ঈদগাহে যাওয়ার সময় চুপে চুপে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা। তাকবিরে তাশরিক হলো-আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।
ঈদের নামাজের বিধান : দ্বিতীয় হিজরিতে ঈদের নামাজ ওয়াজিব হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, ঈদের নামাজ পড়ার বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূল (সা.) মৃত্যু পর্যন্ত কোন বছরই কোন ঈদের নামাজ পড়া বাদ দেননি। তেমনি ফুলাফায়ে রাশিদিনের কেউ তা বাদ দেননি। এর দ্বারা ঈদের নামাজ ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে গুনাহাগার হবে।
ঈদের নামাজের তারিখ : রমাদান শেষে ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়া ওয়াজিব। তবে যুক্তিসঙ্গত ওজর থাকলে পরের দিন পড়া যাবে। অবশ্য ঈদুল আযহার নামাজ ওজর থাকলে পরবর্তী দুদিন পর্যন্ত পড়া জায়েয। ঈদের নামাজের সময় সূর্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠার পর অর্থাৎ সূর্যোদয়ের ২৩-২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদের নামাজের ওয়াক্ত। সূর্য তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোন নামাজ পড়া জায়েয নেই।
ঈদের নামাজের স্থান : হযরত আবু সা’ঈদ আল খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহার’ দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সকলকে সাথে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তেন। অথচ মসজিদে নববীতে এক রাকাত নামাজে এক হাজার, কোনো কোনো বর্ণনায় দশ হাজার ও পঞ্চাশ হাজার রাক’আত নামাজের সাওয়াব লাভের সুসংবাদ রয়েছে।
এতদসত্ত্বেও নবী (সা.) মসজিদে নববীতে ঈদের নামাজ না পড়ে সকলকে নিয়ে ঈদগাহে চলে যেতেন এবং সেখানে নামাজ আদায় করতেন। তাই আলিমদের মত হলো ঈদগাহে নামাজ পড়া উত্তম। অবশ্য মসজিদে পড়ে নিলেও ঈদের নামাজ আদায় হয়ে যাবে, তবে বিনা ওজরে মসজিদে ঈদের নামাজ না পড়া ভালো। বৃষ্টির কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়া জায়েয আছে। হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, “একবার ঈদের দিনে বৃষ্টি হল, তখন রাসূল (সা.) তাদেরকে নিয়ে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়লেন।” (আবি দাউদ-১১৬০)। এতে বুঝা যায় বৃষ্টি বা অন্য কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়া জায়েয।
আতশবাজি করা নিষেধ : অনেক জায়গায় দেখা যায়, ঈদের চাঁদ উঠামাত্র ছোট বড় অনেকে আতশবাজি আর পটকা নিয়ে মেতে উঠে। এতে একদিকে ইবাদতকারীদের একাগ্রতা নষ্ট হয়। বাচ্চারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়। অর্থের অপব্যয় হয়। কখনো কখনো বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। সামান্য অসতর্কতার কারণে আগুন লেগে দোকানপাট অগ্নিদগ্ধ হতে পারে।
এমনকি মানুষও মারা যেতে পারে। পটকা ইত্যাদি ক্রয় করার জন্য টাকা পয়সা না দেওয়া অভিভাকদের উচিত। অনুরূপভাবে মসজিদ, ভবন ইত্যাদিতে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়ের আরেকটি উৎস, ইসলামের এর কোন অনুমোদন নেই। এটা বিজাতীয় সংস্কৃতি, হিন্দুদের কুপ্রথা। এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা মুসলমানদের উচিত।
মাহমুদুল হাসান সুমন
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ।
মন্তব্য করুন