বগুড়ার স্বেচ্ছাসেবক দলনেতা মিজানকে কেন খুন করা হয়
স্টাফ রিপোর্টার : এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুবদলের বহিস্কৃত নেতা সুমন আহমেদ বিপুলের সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে বগুড়া সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মিজানুর রহমান মিজান (৩৫) খুন হয়েছেন।
পথের কাঁটা সরিয়ে দিতে বিপুল ও তার সহযোগীরা মিজানকে খুন করে। এমন তথ্য দিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে পুলিশ বলছে, মিজান হত্যাকান্ডে বিপুলসহ বিভিন্ন জনের নাম উঠে এলেও এ হত্যাকান্ডে জড়িত কারা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মামলা হলে আসামিদের নাম জানা যাবে।
এদিকে, মিজান হত্যাকান্ডের পর গণপিটুনিতে নিহত সানোয়ার হোসেন লেদো ছিল বিপুল গ্রুপের সদস্য। যে কারণে মিজানের অনুসারীদের হাতে গণপিটুনিতে লেদো নিহত হয়। লেদো (৪০) গোকুল উত্তরপাড়ার বুলু মিয়ার ছেলে।
হত্যার নেপথ্যে : স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন থেকে সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মিজান ও গোকুল ইউনিয়ন যুবদলের সদ্য বহিস্কৃত আহ্বায়ক সুমন আহম্মেদ বিপুলের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। ইতোপূর্বে ওই এলাকায় দুইজন খুন ও মিজানসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটেছে। এ বিরোধ ছিল দীর্ঘ দিনের।
২০১৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি সদরের গোকুল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহবায়ক সনি রহমানকে খুন করা হয়। সনি খুনের পর থেকেই মিজানের সাথে বিপুলের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর যুবদলের বহিস্কৃত নেতা বিপুল ও তার সহযোগীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিপুল ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় গত ১০ সেপ্টেম্বর যুবদলের নেতা বিপুলকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। কিন্তু বহিস্কারের বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি বিপুল। তার বহিস্কারের পেছনে মিজানের হাত রয়েছে এটা ভেবে বিপুলের মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে। এ কারণে ক্ষুব্ধ বিপুল ও তার সহযোগীরা পথের কাঁটা মিজানকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপুলের নেতৃত্বে দুর্বত্তরা ৬-৭টি মোটরসাইকেলে এসে মিজানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাাত করে চলে যায়। পরে লোকজন মিজানকে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এরপর মিজানের ঘাতক সন্দেহে গণপিটুনি দিয়ে সানোয়ার হোসেন ওরফে লেদোকে হত্যা করা হয়।
নিহত মিজানুর রহমান মিজান গোকুল উত্তরপাড়ার আফসার আলীর ছেলে ও প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক মামলার আসামি ছিলেন। প্রতিপক্ষ নিহত সানোয়ার হোসেন লেদো একই এলাকার বুলু মিয়ার ছেলে।
যেভাবে হত্যা করা হলো : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বগুড়া সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মিজান রাত ৮টার দিকে গোকুল ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের অদূরে আন্তঃজেলা ট্রাক পরিবহন শ্রমিক অফিসে বসে ৬-৭ জনের সাথে গল্প করছিলেন, এসময় বিদ্যুৎ ছিল না।
তখন কয়েকজন দুর্বৃত্ত ৬-৭টি মোটরসাইকেলযোগে এসে তাদের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা মিজানের ঘাড় ও গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাত করে চলে যায়। পরে লোকজন মিজানকে ওই হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আগেও মিজানের ওপর হামলা হয় : এর আগেও চলতি বছরের গত ৬ মে মিজানুর রহমান মিজানের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এদিন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে মহাস্থান আসার পথে তাকে বহনকৃত সিএনজি অটোরিকশার পেছন থেকে ধারালো অস্ত্রের কোপ বসানো হয়। এসময় মিজানকে বহনকারী অটোরিকশাটি দ্রুত মহাস্থান গ্রামে আসলে তিনি প্রাণে রক্ষা পান। তার প্রতিপক্ষ বিপুল ও তার লোকজন এ হামলা চালিয়েছিল বলে জানা যায়।
সেইসাথে ৫-৭ বছর আগে গোকুলে মিজানের ওপর আবারও হামলা হয়। দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার হাত ও পায়ে রগ কেটে দেয়। সেই থেকে খুরিয়ে খুরিয়ে চলাফেরা করছিলেন মিজান।
আরও পড়ুনআগেও দু’গ্রুপে সংঘর্ষ হয়েছে : অভ্যন্তরীণ বিষয় ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গোকুল এলাকায় মিজান ও বিপুলের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। এমনকি দু’জন খুনের ঘটনাও এর আগে ঘটেছে। তারপরও থেমে থাকেনি তাদের দ্বন্দ্ব। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২০১৮ সালে ২৩ ফ্রেরুয়ারি বিপুলের পক্ষের লোকজন মিজানুর রহমানের পক্ষের ওপর হামলা চালায়।
এসময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মিজানুর, তার স্ত্রী নিশা, আব্দুল হাকিম ও কর্মী গোকুল মধ্যপাড়ার জামাত আলীর ছেলে সনি আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সনি মারা যান। এর জের ধরে গত ২০২০ সালে সুমন আহম্মেদ বিপুল গ্রুপের সক্রিয় সদস্য আপেল মাহমুদকে (৩৫) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়।
সে সময় নিহত আপেলের সঙ্গে থাকা তার বড় ভাই আল মামুনকে (৩৮) দুই হাতের আঙুল কেটে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টাও করা হয়। সে সময় ঘটনাটি ঘটে বগুড়া সদরের মহাস্থানের অদূরে চন্ডিহারা খোলাগাছির মোড়ের পাশে একটি লিচু বাগানে।
বন্ধু যখন শত্রু : ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে দু’গ্রুপের এই দু’জন নিহত হলেও তাদের মধ্যে বিবাদ ও সংঘর্ষ থেমে থাকেনি। মিজানুর রহমান মিজান ও সুমন আহমেদ বিপুল এক সময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কিন্তু তাদের শত্রুতার সূচনা কোথা থেকে তা কিন্তু নিশ্চিত করা যায়নি। তবে এলাকায় অধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জের ধরে বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয় তারা।
দক্ষ সংগঠক ছিলেন মিজান : বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব আবু হাসান জানান, দক্ষ সংগঠক ও জনপ্রিয় নেতা ছিলেন মিজানুর রমান মিজান। দলের জন্য বহু মামলার আসামি হয়েছেন। জেলও খেটেছেন একাধিকবার। মিজান নিহত হওয়ায় শূণ্যতার সৃষ্টি হলো। তিনি আরও বলেন, মিজানুর রহমান তার সংগঠনের প্রাণ ছিলেন। তার সাথে বহিস্কৃত যুবদল সভাপতি বিপুলের বিরোধ চলে আসার বিষয়টি সকলে জানেন। ওই বিরোধের জের ধরেই মিজানকে হত্যা করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা : এদিকে, মিজানের ঘাতক সন্দেহে রাতেই গোকুল এলাকায় স্থানীয় লোকজন লেদোকে আটক করে গণপিটুনি দেয়। এরপর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত লেদোকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
কিন্তু ভর্তির আগেই সেখানে উপস্থিত বিক্ষুব্ধ লোকজন লেদোকে ফের বেদম মারপিট করে। এরপর রাত আনুমানিক ১১টায় লেদো মারা যায়। হাসপাতালে লেদোকে মারপিট করার সময় ভিডিও করছিলেন কয়েকজন সাংবাদিক। কিন্তু বিক্ষুব্ধ কর্মীরা সাংবাদিকদের দিকে তেড়ে আসে এবং তাদের মারপিট করে। মারপিটে যমুনা টিভির ব্যুরো প্রধান মেহেরুল সুজনসহ পাঁচ সাংবাদিক আহত হন।
ওসি’র বক্তব্য : বগুড়া সদর থানার ওসি মো. সাইহান ওলিউল্লাহ দৈনিক করতোয়াকে বলেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মিজানুর রহমান মিজানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তবে এ হত্যার ঘটনায় বিপুলসহ কয়েকজনের নাম শোনা গেলেও হত্যাকারী কারা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মামলা হলে আসামিদের নাম জানা যাবে। তবে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে মিজানের মরদেহ আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
ফাঁসির দাবি : ময়নাতদন্ত শেষে মিজানের লাশ তার গ্রামের বাড়ি গোকুল উত্তরপাড়ায় আনা হয়। এসময় হাজারো মানুষ তার লাশ এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেন। এসময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। এসময় আগত লোকজন বিপুলসহ হত্যাকারীদের ফাঁসি দাবি করেন।
মন্তব্য করুন