রেমিট্যান্সের জোয়ার আসুক দেশে
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত প্রবাসী আয়। যদি প্রশ্ন করা হয়- দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে সবচেয়ে বড় অবদান কাদের ? এক কথায় উত্তর আসবে রেমিটেন্সে বা প্রবাসী যোদ্ধাদের আয়। এই যোদ্ধারাই দেশের আশির্বাদ স্বরূপ। এই যোদ্ধাদের লড়াইটা চোখে পড়ে না, তবে বর্তমান বাস্তবতায় এই যোদ্ধারাই দেশের আশির্বাদ স্বরূপ। রিজার্ভ গঠন এবং বহির্বিশ্বে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বের ১৬৮টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ।
দেশের প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয় মাত্র ৫০ ডলারের কিছু বেশি। এত বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের মত দেশের জন্য খুব ঝুঁকি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে আসছে, তার অন্তত ৯০ শতাংশ বৈধপথে আনতে পারলে প্রবাসী আয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
হুন্ডি ও অনান্য মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের বড় একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। নানা তথ্যে জানা যায়, দেশে আসা সব রেমিট্যান্স বৈধ পথে এলে, তথ্য পাচার বন্ধ হলে বার্ষিক রেমিট্যান্সের আকার দাড়াবে ৫০ মিলিয়ন ডলারে।
আসল সত্যটা হলো, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রবাসি আয়ের বড় অঙ্কই পাচার হয়ে যাচ্ছে। যার বার্ষিক অঙ্ক প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। অথাৎ প্রবল কষ্টের মাধ্যমে প্রবাসিরা যে আয় দেশে পাঠায় তার অর্ধেকেই পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কথা শুনলে কার মন খারাপ হবে না বলেন। প্রবাসিদের মন তো খারাপ হবেই। আরো জানা গেছে, আমাদের প্রবাসি আয়ের মাত্র ৫১ শতাংশ আসে বৈধ পথে আর বাকিটা আসে হুন্ডির মাধ্যমে।
এটা বিবেচনায় নিলে আমাদের প্রাক্কলিত প্রবাসী আয়ের পরিমান বর্তমান প্রাপ্ত ২২-২৩ বিলিয়ন ডলার বিবেচনায় নিয়ে ৪০-৪২ বিলিয়ন ডলার। তার এই তথ্য ভিত্তি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়,- দেশে আসা সব রেমিট্যান্স বৈধ পথে এলে, তথ্য পাচার বন্ধ হলে রেমিট্যান্সের পরিমান দাঁড়াবে ৫০ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। প্রবাসী আয় সংগ্রহে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহারাইন, লিবিয়া, ইরান প্রমুখ। তবে ইদানিং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ কয়েকটি দেশ থেকে প্রবাসী আয় আসছে বেশি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে থেকে।
কেন্দ্রিয় ব্যংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরে প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগষ্ট) দেশে প্রবাসি আয় এসেছে ৪১৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে শীর্ষ ১১টি দেশ থেকে এসেছে ৩৬৩ কোটি ডলার। আর মাত্র ৫টি দেশ থেকে এসেছে ২৪৬ কোটি ডলার। প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে প্রাবাসী আয় বৃদ্ধি করতে হবে। আর তা করতে হলে শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে।
এ প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রদান করবে যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে আরও তৎপর দেখাতে হবে। এ কাজে অন্য কিছু দেশের মতো বিশ্বব্যাংকের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় বাড়াতে প্রধান কাজ হচ্ছে হুন্ডি ব্যবসায়ীর দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।
আরও পড়ুনবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হলো রেমিট্যান্স প্রেরণে উচ্চ ফি বা সার্ভিস চার্য এবং নির্ধারিত সীমা (সিলিং), হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বা প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়দের দেশে ব্যাংক একাউন্ট থাকে না, আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা, অননুমোদিত ব্যবসা বা কাজের আয় বৈধ পথে প্রেরণের সুযোগ না থাকা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে সচেতনতা ও উৎসাহের অভাব।
তবে বর্তমানে রেমিট্যান্সের গতিপ্রবাহ বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রেমিট্যোন্স এসেছে ৭৮ হাজার ২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা লাগে, এ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ২২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। পরের মাসেই তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং সেপ্টেম্বরে তা এসেছে ২৮ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। কেন্দ্রিয় ব্যাংক আরো জানাচ্ছে, চলতি মাস অক্টোবরের শুরুতেই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এভাবে রেমিট্যান্স আসার ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে তা আড়াই বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। যা আশাব্যঞ্জক।
জানা গেছে, প্রবাসী কর্মি পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ষষ্ঠ। বিশ্বের প্রায় ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের প্রবাসীরা আছেন। যারা প্রবাসী তারা আমাদের দেশের মেরুদন্ডের মতো। প্রবাসীরা এক সঙ্গে দুটি কাজ করে। এক. তাদের পাঠানো টাকায় দেশ উপকৃত হয় দুই. তাদের নিজের পরিবার উন্নত হয়। তাই প্রবাসীদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখা দরকার।
তাদের সন্তানদের স্কুলে-কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত। প্রবাসীদের জন্য আলাদা ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা চালু করা উচিত। প্রবাসীরা অনেক সময় বিদেশ থেকে এসে বিমান বন্দরে এসে নানা হেনস্তায় পড়েন। তা থেকে তাদের উত্তরণ করতে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তাঁরা যোদ্ধা। সবসময় তাঁদের প্রতি মনেযোগ দিতে হবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কলামিষ্ট
01725045105
মন্তব্য করুন