দ্রব্যমূল্য : পুরোনো অসুখ, পুরোনো ওষুধ
জিনিসপত্রের দাম আটকানো যাচ্ছে না। বেড়েই চলেছে। সরকার এরই মধ্যে দামও বেঁধে দিলো। বিগত সরকারও একই কাজ করেছিল। নতুন সরকারও তাই করল। অর্থাৎ একই অসুখের জন্য একই ওষুধ দিলো। যে ওষুধে আগে কাজ হয়নি সে ওষুধে এখন কাজ হবে?
এর সোজা ও স্পষ্ট উত্তর-না। তাহলে সরকারগুলো এটা করে কেন? কেন করে তার তালগোল এই রচনার প্রথম বাক্যের মধ্যেই নিহিত। বলা হয়েছে ‘দাম আটকানো’র কথা। দাম ‘বেঁধে দেয়া’ তো আটকানোই। কিন্তু বাজার অর্থনীতিতে কোনো জিনিসের দাম কখনোই আটকানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। করলে বাজার বিগড়ে যায়। আগে যেমন গেছে। এখনও যাবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে জিনিসপত্রের দাম বাজারের ওপরই ছেড়ে দেয়া হয়। এর চরিত্রই এরকম। হয়তো বলবেন এটা করেই তো সর্বনাশটা করা হয়েছে। ইচ্ছে মতো দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জিনিসপত্রের দাম এর জন্য বাড়ে না। কেন বাড়ে এর উত্তরও এই রচনার মধ্যে পাওয়া যাবে। আর সারাবিশ্বেই অর্থনীতির সাধারণ সূত্র যেভাবে কাজ করে বাংলাদেশে সেভাবে কাজ করে না। উল্টাপাল্টা আচরণ করে। কারণ আমাদের এখানে এমন কিছু ফ্যাক্টর কাজ করে যা সভ্য দেশে নেই।
কীভাবে একটি পণ্যের দাম নির্ধারণ হয় তার অনেকগুলো উপাদান থাকে। অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্র দিয়েই এর ব্যাখ্যা দেয়া যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে দাম ওঠানামা করে। আর বলে রাখা ভালো অর্থনীতির সূত্রগুলোর ক্ষেত্রে একটি সাধারণ ফ্যাক্টরের কথা বলা হয়েছে- তা হলো ‘যদি অন্যান্য ফ্যাক্টর ঠিক থাকে।’ আমাদের দেশে এই ‘অন্যান্য ফ্যাক্টরের’ মধ্যে কিছু ভূত থাকে। ওই ভূত তাড়ানো জরুরি।
যখন দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় তখন অর্থনীতির সাধারণ এই সূত্র প্রথমে আহত হয়, তারপর ব্যাহত হয়। এরপর আবার আগের মতো হয়ে যায়। তার মানে দাম নির্ধারণ কাজ করে না। লক্ষ্য করে দেখবেন বিগত সরকারের এই অস্ত্র কাজ করেনি। কেন করেনি বা এই অস্ত্র কেন কাজ করে না তা একটি উদাহরণ দিলেই খোলাসা হয়ে যাবে।
মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-যোগানের ওপর ভিত্তি করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম ওঠানামা করে। মূল্য বেঁধে দিলে এর উচ্চতম দামকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় সিলিং। নিম্নতম দামকে বলা হয় ফ্লোর। ধরা যাক একটি পণ্যের বর্তমান দাম ৫০ টাকা। যা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার উর্ধ্বে। সরকার এর দাম নির্ধারণ করে দিলো চল্লিশ টাকা। আমরা খুশিতে বাকবাকুম করলাম।
কিন্তু আলটিমেটলি কী হবে দেখুন। সাধারণ জনগণ মনে করবে যেহেতু দাম কমেছে তাই একটু বেশি করে কিনে রাখি। কখন আবার দাম বেড়ে যায়! আপনি যেখানে এক কেজি কিনতেন দাম কমে যাওয়াতে দুই কেজি না কিনলেও দেড় কেজি কিনবেন। তার মানে বাজারে ওই জিনিসের কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হলো। সরবরাহ কিন্তু স্থির অথবা নিম্নমুখী। এর কারণ হলো খুচরা বিক্রেতার এই দামে বিক্রি করতে অনীহা। ৫০ টাকায় বিক্রি করলেই তার কিছু থাকে।
৪০ টাকায় বিক্রি করলে থাকে না। এজন্য সে পাইকারের কাছ থেকে তখন মাল কিনতে অনীহা বোধ করে। এভাবে এই কৃত্রিম চাহিদা ও খুচরা বিক্রেতার অনীহার কারণে বাজারে যোগানের পরিমাণ কমে যায়। তখন বাজারের চরিত্র অনুযায়ী ওই দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ৪০ টাকা থাকে না। জনগণের কৃত্রিম চাহিদা ওই দামকে আবার ৫০ টাকাতেই ঠেলে তুলে নিয়ে যায়। যখনই দাম এভাবে উপরে ওঠে তখনই খুচরা বিক্রেতা পাইকারের নিকট থেকে আবার মাল কেনে ৫০ টাকায় বিক্রি করে।
তার মানে ঘুরে ফিরে ওই বাড়তি দাম ৫০ টাকাই প্রতিষ্ঠিত। এই চক্রের মধ্যে আমরা পড়ে আছি দীর্ঘদিন। দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা এখান থেকে বের হতে পারছি না। দরকার আসল ওষুধ। দাম বেঁধে দেয়ার টোটকায় কাজ হচ্ছে না। হবেও না। যেমন সম্প্রতি (০৯ অক্টোবর) কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নিত্যপণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেখানে কাঁচা মরিচের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে প্রতি কেজি ৬০ টাকা ২০ পয়সা। ১৩ অক্টোবর কারওয়ান বাজারে এই কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে ৩২০ টাকায় (বণিক বার্তা, ১৪/১০/২০২৪)।
আমাদের দেশের জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের জন্য অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটিকে ধরা হয় উৎপাদন ঘাটতি। বিশেষ করে এই সময়ে বলা হচ্ছে। অসময়ে বন্যা ও অতিবৃষ্টিকে দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন ইদানিং এই ঘাটতির সাথে যুক্ত হয়েছে সরবরাহজনিত ঘাটতি । তাও কৃত্রিম। উৎপাদন ঘাটতি থাকলে দাম বাড়বে সেটাও মেনে নিতে হবে। দেখতে হবে কৃষক পর্যায়ে বিক্রয় মূল্যের সাথে ভোক্তা পর্যায়ের ভোক্তামূল্য কত। আমাদের দেশে এটা একটুও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এটা অতীতে যা ছিল এখনো তাই।
তাহলে সরকারের করণীয় কী? কিছু চিত্র তুলে ধরি। বগুড়ায় কৃষক পর্যায়ে কাঁচা মরিচ বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩৭০ টাকা। কারওয়ান বাজারে সেই মরিচ পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫০০ টাকা। মোহাম্মাদপুরের কৃষি মার্কেটে ওই একই কাঁচা মরিচ খুচরায় বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকায় (প্রথম আলো ১৫/১০/২০২৪)। এর ব্যাখ্যা কী দেবেন? পৃথিবীর কোনো অর্থনীতিবিদ এই সূত্র মেলাতে পারবেন? পারবেন না। অ্যাডাম স্মিথ এটা জানলে স্ট্রোক করে মারা যেতেন। অথচ আমরা এটাকে খুব স্বাভাবিক হিসেবেই মেনে নিয়েছি।
অবশ্য ভোক্তা অধিকার পরিষদ এর ব্যাখ্যা জানেন। তারা বিবৃতিতে জানান, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কারওয়ান বাজারে সবজির ট্রাক আসে রাত ১২টার দিকে। এরপর ট্রাক থেকে সবজি ৬-৭ বার হাত বদল হয়ে তা খুচরা পর্যায়ে আসে- (প্রথম আলো ১৫/১০/২০২৪)। খেয়াল করে দেখুন তাদের বিবৃতির মধ্যেই মূল্য বৃদ্ধির আসল কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। ‘৬-৭ বার হাত বদল’। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে জিনিস পত্রের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চাবিকঠি।
আরও পড়ুন১৭ অক্টোবর ডিসিসিআই (ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি) নিত্যপণ্যের বাজারদরের ওপর এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো দ্রব্যের মূল্য হাতবদলের কারণে ৯ গুণ পর্যন্ত বাড়ে (প্রথম আলো ১৮ অক্টোবর)। লেখক হিসেবে আমার মাথা ঠিক আছে। বলবেন যে ভুল লিখেছেন। না। ভুল লিখিনি। কোনো সভ্য বাজার ব্যবস্থাপনায় এতগুলো হাত বদল আর এতগুণ দাম বাড়তে পারে তা আমার জানা নেই।
ওই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের গড় উৎপাদন ব্যয় ৪৯ টাকা ৬০ পয়সা। গত আগস্টে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ২৩৬ টাকায়। তার মানে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে পৌনে ৫ গুণ বেশি দামে কাঁচা মরিচ কিনেছেন ভোক্তারা। এখন তো দাম আরও বেড়েছে। হলুদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে প্রতি কেজি হলুদের উৎপাদন খরচ ৩৪ টাকা ৭৬ পয়সা। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয় ৩২৩ টাকায়। অর্থাৎ উৎপাদন খরচের তুলনায় ৯ দশমিক ৩০ গুণ বেশি দামে কিনতে হয়েছে ভোক্তাদের। (প্রথম আলো, ১৮ অক্টোবর)
ভোক্তা পর্যায়ে এত উচ্চমূল্যে পণ্য কিনলেও উৎপাদক পর্যায়ে অর্থাৎ কৃষক এই দাম পান না। কে পান? সেটা বুঝতে হলে যেতে হবে বন্দে আলী মিয়ার কবিতায়, ‘আষাড়ে নামিলে ঢল খালে আর বিলে/ মনু মিয়া মাছ ধরে নিয়ে যায় চিলে।’ মনু মিয়া মানে আমাদের কৃষক উৎপাদন করলেও নিয়ে যায় চিলে? এই চিল কারা? এই চিল হলো কিছু পরোক্ষ খরচ, মজুতদারী, কৃত্রিম সংকট উৎপাদনকারী, হাত বদলের অযৌক্তিক স্তর ও কারিশমা- এককথায় বাজার-ভূত।
সরকারের কাজ এখানেই। এই ভূত তাড়াতে হবে। হাত বদল কমাতে হবে। একটি বা দুটির বেশি নয়। হাত বদলের সময় মার্জিন নির্ধারণ করে দিতে হবে। তা হবে দালিলিক। রশিদ থাকবে। অটোমেশন অবশ্যই জরুরি। এখন তো প্রকাশ্য চাঁদাবাজি নেই। গোপন চাঁদাবাজি থাকলে তার খেল খতম করতে হবে। বাজার মনিটরিং করতে হবে জোরালোভাবে এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে।
একসময় ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন জরিপ করা হতো। এটাও ফিরিয়ে আনা দরকার। এককথায় বাজারে শৃঙ্খলা আনতে হবে। সরকারের কাজ দক্ষতার সাথে বাজার-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা ও তা অব্যাহত রাখা। দাম নির্ধারণ করা সরকারের কাজ নয়। কারণ সরকার ব্যবসা করে না। জিনিসপত্রও সরকারের দখলে থাকে না।
উটপাখির মতো দেখতে এক ধরনের পাখি আছে- ইমু পাখি, পেছনে হাঁটতে পারে না। আমাদের দেশের জিনিস পত্রের দামও ইমু পাখির মতো। শুধু সামনেই যায় আর সামনেই যায়। আমরা জনগণ কী আর করি। প্রথমে কিছুদিন গাঁই গুঁই করি। তারপর কস্ট কাটিং করি। মাংস-দিবস কমে আসে। পিসের সাইজ ছোট করি। বিকল্প ও কম দামের খাবারের দিকে হাত বাড়াই।
এভাবে জীবন-মান কমিয়ে ফেলি। কিছুদিন পর কলমি শাকের মতো চুপ হয়ে যাই। এই ইমু পাখিকে থামাতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা দিয়ে, মনিটরিং দিয়ে। আমাদের দেশে মনিটরিং করতে হবে সাইকেল চালানোর মতো করে। পেডেল মারতেই হয়। পেডেল না মারলে আপনি পড়ে যাবেন। দামের উর্ধ্বগতি থামাতে পারবেন না।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা কথা দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেছিলেন, ‘দারিদ্র অল্প কিছু চায়, শৌখিনতা চায় অনেক কিছু আর অর্থলিপ্সা চায় সবকিছু।’ ওই ‘সবকিছু চাওয়া’ লোকদের খুশি করতে গিয়ে দারিদ্রের অল্প চাওয়াকে নস্যাৎ করা উচিত নয়।
লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক
emrankabir81@gmail.com
01719-455492
মন্তব্য করুন