শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে আবারও ক্ষতিতে শিক্ষার্থীরাই
নাসিমা সুলতানা ছুটু : ‘হঠাৎই যেন পড়ালেখার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়ে গেল। যে গতিতে পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিচ্ছিলাম, পরীক্ষা আবার শুরু হলে সেই মনোযোগটা ফিরে পাবো কি না, এটা নিয়ে আমি সত্যিই শঙ্কিত?’ এভাবেই বলছিলেন এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাসফিয়া তানজিম।
তাসফিয়া বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোসহ সারা দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমনই শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন তাসফিয়াসহ অন্যান্য শিক্ষার্থী।
তাসফিয়া বলেন, আগামি ৭ আগস্ট আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের তত্ত্বীয় পরীক্ষাগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিলো। রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিতের মত কঠিণ বিষয়ের পরীক্ষাগুলো এখনও বাকি আছে। ২১ ও ২৩ জুলাই রসায়ন এবং ২৯ ও ৩১ আগস্ট গণিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিলো।
সরকার ১ আগস্ট পর্যন্ত সকল পরীক্ষা স্থগিত করেছে। স্থগিতকৃত পরীক্ষাগুলো নাকি ১১ আগস্টের পর নেওয়া হবে। এদিকে আগামি ৫ এবং ৭ আগস্ট রয়েছে গণিত পরীক্ষা। এখন পর্যন্ত ৫ ও ৭ আগস্টের পরীক্ষা নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী হবে,- এই রকম কোন ঘোষণাও আমরা পাইনি। তাই সত্যি আমরা যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী তারা অস্থিরতায় সময় পার করছি।
প্রায় তিন বছর ধরে করোনা ভাইরাসের ক্ষত সরানোর চেষ্টা চলছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়। মহামারীতে দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার বহুমুখী ক্ষতি এখনও কাটানো যায়নি। এই বছরের শুরুতেই বেশ কিছুটা সময়জুড়ে শৈত্যপ্রবাহের পর তীব্র দাবদাহ ও বন্যায় ক্ষতির শিকার শিক্ষাকার্যক্রম যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই শুরু হল কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে অচলাবস্থা।
তাসফিয়ার মত অনেক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকসহ শিক্ষাবিদরা শিক্ষা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন। দফায় দফায় শ্রেণি কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্নতা শিখন কার্যক্রমে অংশ নিতে নিচের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনাগ্রহ-অনীহা বাড়িয়ে তুললে তা বার্ষিক মূল্যায়ন ও চূড়ান্ত পরীক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা শিক্ষক ও অভিভাবকদের।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে গত ১৬ জুলাই থেকে ধাপে ধাপে বন্ধ করা হয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সংঘাত বাড়তে থাকলে জারি করা হয় কারফিউ। আস্তে আস্তে কারফিউ শিথিল হচ্ছে, সচল হচ্ছে অফিস-আদালত। জনসমাগম বাড়ছে সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে, সেটি এখনও নির্দিষ্ট হওয়া যাচ্ছে না।
স্কুলের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। পেনশন স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের কর্মবিরতি-বিক্ষোভে আগে থেকেই ক্লাস বন্ধ ছিল। এখন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘ সেশনজটের চক্রে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি এই প্রথম প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ রয়েছে। করোনাকালীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকলেও অনলাইনের মাধ্যমে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি কার্যক্রম থেকে পাঠদান পর্যন্ত চলেছে।
এমন কী সেই সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে ফলাফল পর্যন্ত দিয়েছে। ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থী জানান, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ষষ্ঠ সেমিস্টার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ফলাফল এবং ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে পরের সেমিস্টারের জন্য রেজিস্ট্রেশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তা পিছিয়ে গেছে।
জানিনা কবে নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। করোনার সময় অনলাইনে আমরা ভর্তি হয়েছিলাম এবং বাড়ি থেকে অনলাইনে ক্লাস করেছি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অন্যতম একটি কারণ ছিল এখানে সেশনজট নেই। কিন্তু এবার হয়তো আমরা সেই সেশনজটেই পড়ে গেলাম।
বগুড়া ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাফিয়া রুবাইয়া ষান্মসিক মূল্যায়ন দিচ্ছিলেন। রাফিয়া বলেন, “ক্লাস বন্ধ থাকলে বাসায় তেমন পড়াশোনা হয় না। কারণ ক্লাসে বোঝানোর ব্যাপার থাকে। নিজে বই পড়ে কিছুটা আইডিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু তেমন লাভ হয় না। আর বাসায় বসে থাকতে ভালোও লাগে না। গরমের সময়ও বেশ কয়েকদিন স্কুল বন্ধ ছিল। পরে স্কুল খোলার পর অনেক চাপ পড়ে যায়। তখন কষ্ট হয়ে যায়।’
রাফিয়ার মা মৌসুমী বলেন, “স্কুল বন্ধ থাকায় এক ধরণের ক্ষতি হচ্ছে বাচ্চাদের। আবার স্কুল খুললে আরেক ধরণের ভয় কাজ করবে। স্কুলে যাওয়া বা ফেরার পথে সহিংসতায় পড়ে গেলে প্রাণে বাঁচাই কঠিন হয়ে যাবে। বগুড়া জিলা স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আদিব আল রাফির মা রাবেয়া তাবাসসুম বলেন, আন্দোলন শুরুর ক’দিন আগেই আদিবের ষান্মাসিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
এখন ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। স্কুল বন্ধ থাকলে বাচ্চারা বাসায় একেবারে পড়তে চায় না। তাদের রুটিনমাফিক সুশৃঙ্খল জীবনে যেন এলোমেলো হয়ে যায়। আর এখন যেহেতু নতুন শিক্ষাক্রম তাই ক্লাস না করলে তো বাচ্চারা পিছিয়ে পড়বে। আগের সেই কারিকুলাম না যে, বাসায় বসিয়ে সিলেবাস কমপ্লিট করাব। এখন তো প্রচুর গ্রুপ ওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট থাকে ওদের। তাই স্কুল বন্ধ থাকলে বই শেষ করতে পারবে না। তখন তো শিখন ঘাটতি থেকে যাবে।
এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাসফিয়া তানজিমের মা পলি জানান, পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার গতি কমে গেছে। এছাড়া তাদের এক ধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলন এবং আন্দোলনকে ঘিরে বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে ওদের ইমোশন কাজ করছে।
আরও পড়ুননেট যখন বন্ধ ছিল, তখন একটু স্বস্তি ছিল এবং পড়ার টেবিলে থাকতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু নেট খোলার পর ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যখন বিভিন্ন ভিডিও ও সংবাদ দেখছে, তখন আবাও সেই অস্থিরতা ও ইমোশন দেখছি।
এছাড়া পরীক্ষা পেছানোতে ওদের মনোযোগের যে ঘাটতি রয়েছে এর প্রভাব পড়বে ফলাফলে। যেসব শিক্ষার্থী আগামি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে তাদের অভিভাবকদের শঙ্কা, শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেললে তার প্রভাব পড়বে ফলাফলে। বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর মা রেজিনা বেগম জানান, ওদের এসএসসি পরীক্ষার আর কয়েকটা মাস বাকি।
এমনিতেই ছেলেটা পড়াশোনা করতে চায় না। স্কুল-কোচিং খোলা থাকলে তাও কিছুটা পড়ালেখা হয়। এখন একেবারে বই নিয়ে বসছে না। সারা দিন গেইমস খেলছে মোবাইলে। এভাবে তো সব পড়া ভুলে যাবে। পরে রেজাল্টটা খারাপ হলে সারা জীবনের ধাক্কা হয়ে থাকবে।
পিছিয়ে গেল একাদশে ভর্তি ও পাঠদান কার্যক্রম। এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে ৩০ জুলাই একাদশের ক্লাস শুরুর পরিকল্পনা জানিয়েছিল সরকার। তবে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীরা ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি।
আন্তঃশিক্ষাবোর্ড সমন্বয় কমিটির এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, ভর্তি কার্যক্রম শেষ করতে সময় বাড়ানোর পাশাপাশি একাদশের ক্লাস শুরুর সূচিও পেছানো হয়েছে। নতুন করে আগামী ৬ অগাস্ট থেকে একাদশের ক্লাস শুরুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এদিকে জুনে শিক্ষাবর্ষ শেষে জুলাই থেকে ক্লাস শুরুর কথা থাকলেও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা এখনও ক্লাস শুরু করতে পারেনি।
বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কী ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কী করা প্রয়োজন জানতে চাইলে বগুড়া বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিবাবক সবারই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। শিখন ঘাটতির ধাক্কা কাটাতে ছুটি কমিয়ে এনে অথবা ক্লাসের সময়সীমা বাড়িয়ে অতিরিক্ত পাঠদানের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার এবং যে কোনো সরকারি ছুটির দিনও ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করে ক্ষতি যতটা পুষিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই করতে হবে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভভাবকদের উপর একটু চাপ পড়লেও করার কিছু নেই।
শিক্ষার ক্ষতির এই বিষয়টি নিয়ে বগুড়া সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ রেজাউন নবী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আর একবার মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেলে তা ফিরে আসা একটু কষ্টকরই হয়।
বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, সরকার শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেন এবং শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার যেভাবে দিক নির্দেশনা দিবেন আমরা ঠিক সেভাবেই কাজ করবো।
বগুড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার বলেন, কখনও প্রাকৃতিক, তো কখনও বৈষয়িক, কিংবা মনুষ্য সৃষ্টি দুর্যোগে বার বার আমাদের শিক্ষার যে ক্ষতি হচ্ছে তা থেকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমরা কেউ জানি না।
বৈষয়িক মহামারী করোনায় প্রায় দেড় বছরের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। যদিও সে সময় সরকার অনলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ কতভাগ শিক্ষার্থী পেয়েছে? ওই ক্ষতি আমরা এখনও পুরোপুরি কেটে উঠিনি।
এরপর কখনও অতিমাত্রার শীত তো কখনও তীব্র তাপদাহ কিংবা ভারী বর্ষণ বা বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। আর এবার যেটি হলো মনুষ্য সৃষ্টি দুর্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম এমন একটি কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষার্থীদের উপর এটির একটি নেতিবাচক ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাই সরকারের উচিৎ খুব শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া।
মন্তব্য করুন