ভিডিও রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ছেলেদের পেশায় মেয়েদের সফলতা

ছেলেদের পেশায় মেয়েদের সফলতা, ছবি: সংগৃহীত

নিজের আলোয় ডেস্ক : আমরা বর্তমানে এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রতিনিয়তই জেন্ডার ছাঁচ ভেঙে সমতা প্রতিষ্ঠার কথা চলছে। সব ধরনের কর্মক্ষেত্রেই জেন্ডার সমতা আনয়নের আলাপ উঠছে।

রাকা নোশিন নাওয়ার : চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং স্টুডিও ইয়োলো সামথিং লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা রাকা নোশিন। রাকা বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমার নিজেকে বারবার প্রমাণ করতে হয়েছে। বেশ অনেকদিন ধরে একটি প্রোডাকশন হাউজের অ্যাসিস্টেন্ড ডিরেক্টর ছিলাম। পরে নিজের একটি প্রোডাকশন হাউজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। তবে আশপাশের সবাই আমাকে তখন উৎসাহ দেওয়ার বদলে বরং নিরুৎসাহিতই করেছিল। সবাই বলছিল, এমন ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

আমার মনে হয়, নারীরা বেশিরভাগ সময়ই অন্যান্য অভিজ্ঞ লোকেদের ওপর নিজেদেরকে নির্ভরশীল করে রাখে। এবার আমি আমার কাজের দায়িত্ব পুরোটাই নিজের হাতে নিলাম। নিজেকে শেখালাম কীভাবে একটি কোম্পানি সামগ্রিকভাবে পরিচালনা করতে হয়। আমি নিজে থেকে পড়াশোনা করেছি, আইনি সাহায্যের জন্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং পরিশেষে ২০২২ সালের ২১ আগস্ট আমার জন্মদিনে নিজের কোম্পানি শুরু করেছি। কর্মীদের নিয়োগদান থেকে শুরু করে জায়গা ভাড়া নেওয়া, সবটাই আমি নিজে করেছি। এমনকি অফিসের জন্য জায়গা ভাড়া নিতে গিয়েও সম্মুখীন হয়েছি নানা বাধা-বিপত্তির। জায়গার মালিকরা বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, আমি কেন আমার স্বামী কিংবা বসকে নিয়ে আসছি না। এ ধরনের অযৌক্তিক কথাবার্তা শুনে হতবাক হয়ে গেছি। আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমাকে এমন কোনো প্রশ্ন করা হতো না কিংবা অন্য কোনো পুরুষকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার অনুরোধও আসতো না। একা নারীর জন্য বাসা কিংবা অফিস স্পেস ভাড়া নেওয়া খুবই কঠিন একটি কাজ। তবে আমার কপাল ভালো যে আমার অফিসের জন্য একজন সহযোগী মনোভাবের বাড়ির মালিক পাই, যিনি কি না আমার পরিস্থিতি বুঝে আমাকে জায়গাটি ভাড়া দেন। আর এভাবেই আমি আমার সুন্দর এই যাত্রাটি শুরু করি। তবে প্রথমে অবশ্য কেউই আমাকে খুব একটা আমলে নেয়নি, অন্তত বিজ্ঞাপনের বেলায় তো নয়ই। এক দশক দীর্ঘ একটি ক্যারিয়ার ও চ্যানেল ভর্তি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন থাকা সত্ত্বেও আমার যাত্রাটা শূন্য থেকেই শুরু করতে হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সবাই আমার সক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন এবং কেউই প্রথম প্রজেক্ট হাতে তুলে দেবার সাহস করছিলেন না।

এই দুই বছরে আমি অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি ঠিকই, কিন্তু শুরুটা ভীষণ কঠিন ছিল। আমি জানি যে সব ইন্ডাস্ট্রিরই ভালো-মন্দ রয়েছে, তবে একথা সত্য যে নারী বলে আমাকে একটু বেশিই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে আমি আমাদের ইন্ডাস্ট্রির বহু পুরুষ সহকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞ, যারা আমাকে এই যাত্রায় সাহায্য করেছেন। এখানে সব পুরুষই যে অসহযোগী, তা নয়। আমি আশা করি এই ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত সব নারীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস থাকবে এবং তাদের চলার পথে সহায়তা করার জন্য আমি পাশে থাকতে চাই।'

সুদেষ্ণা এস চৌধুরী : স্টুডিও ডট ও-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মূল স্থপতি সুদেষ্ণা। তিনি বলেন, আমি পেশায় একজন স্থপতি। লাইসেন্স পাবার পরপরই আমি বিভিন্ন ইন্টেরিওর প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করি। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, এ পেশাতেই আমি আনন্দ খুঁজে পেয়েছি এবং আগামীতেও এ নিয়ে কাজ করতে চাই। আর এ থেকেই জন্ম নিলো আমার মানস-সন্তান স্টুডিও ডট ও। আমার মনে হয় স্থাপত্য জগত অনেক বেশি পুরুষকেন্দ্রিক এবং আমি ব্যবসায়িকভাবে সফল যে ব্যক্তিদের মুখোমুখি হয়েছি, তাদের অধিকাংশই পুরুষ। বর্তমানেও খুব কম তরুণীই এই সময়সাপেক্ষ পেশায় রয়েছেন। অন্য অনেক কর্মক্ষেত্রের মতো এখানেও নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু চ্যালেঞ্জ। আর বিষয়টা যখন এমন সব ভূমিকায় এসে দাঁড়ায়, যেখানে বছরের পর বছর ধরে আমরা পুরুষদেরই দেখে যাচ্ছি– যেমন ছুতার, রাজমিস্ত্রী বা অন্যান্য কারিগর যারা নকশাকে বাস্তবে রূপ দেন। আমি কখনো নারীদেরকে কিন্তু এমন পেশায় কিন্তু দেখিনি। কারিগর মানেই যেন পুরুষ। ঠিক যেভাবে নারীরা ইলেকট্রিশিয়ান বা বিল্ডার হয় না, শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মীই হয়। আমাদের এই জায়গাটাতে কিছু বদল আনার সময় এসেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
আমি দেখেছি যে মানুষ কোনো অগ্রজ বা পুরুষকেই স্থপতি হিসেবে দেখতে চায়, কোনো অল্পবয়সী নারীকে নয়। তাই ক্লায়েন্টদের বিশ্বাস অর্জনটা সত্যিই দুঃসাধ্য ছিল আমার জন্য। খুব ছোটবেলায় আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। বাড়িতে ছিল আমার মা ও বোন। বড় হবার সময়টাতে আমার মনে হয়েছিল যে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো ফারাক থাকার কথা নয়– আমি তাই নিজেকে সবসময় একজন ব্যক্তি হিসেবেই মনে করেছি।

আমার বিয়ের পর আমি বাসায় ও অফিসে খুবই ইতিবাচক পরিবেশ পেয়েছি। আমার স্বামী আমার প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল। সেইসঙ্গে রয়েছেন আমার অধ্যাপক, গুরু এবং বর্তমানের ফার্ম বা প্রজেক্টের অংশীদার যিনি একজন পুরুষ। এত সমর্থনের পরও আমার চলার পথে কিছু বাধা এসেছে, এমনকি প্রজেক্টের স্বাভাবিক সমস্যার বিষয়েও আমি ক্লায়েন্টদের অনেকসময় জানাতে পারিনি– পাছে তারা ভেবে বসেন যে আমি সময়মতো কাজ জমা দিতে পারব না। এও হয়তো নারী হবারই ভোগান্তি। তবে আমি এও জানি যে আমাদের আশেপাশে বহু প্রতিভাবান ও অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যবসায়িক নারী ব্যক্তিত্ব আছেন, যাদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।'

আরও পড়ুন

তাসনিম মোর্তজা : শাপলা ট্যাক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও তাসনিম। তাসনিম বলেন, শাপলা ট্যাক্সের যাত্রা শুরু হয়েছিল আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে, যারা সে সময়ে অন্যদের জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করছিলাম। আমাদের মধ্যে সাধারণত সবকিছুই কাস্টম-মেড করার একটা প্রবণতা আছে। ট্যাক্স সল্যুশনের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ব্যতিক্রম নয়। সেইসঙ্গে আমি এমন একটি সফটওয়্যারও চেয়েছিলাম, যার মাধ্যমে বহু লোককে সেবা প্রদান করা যায়। আর এই ভাবনা থেকেই প্রকিউরমেন্টের শুরু। পরে বিষয়টি আরও সহজ করতে যাত্রা শুরু হয় শাপলা এইচআর সফটওয়্যারের, যা কি না কোম্পানিগুলোর এইচআর সংক্রান্ত সকল খুঁটিনাটি বিষয়ে সাহায্য করে।

২০২২ সালে আমরা শাপলা ট্যাক্স শুরু করি, যা কি না কর প্রদানের সব ধরনের সমাধান দিয়ে থাকে। এতে করে কর সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ, ফাইলিং প্রক্রিয়া এবং প্রতিটি ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করে তোলার উপায় রয়েছে। আমরা শুধু ট্যাক্স ফাইলই করি না, ব্যক্তিপর্যায়ে গিয়ে ব্যবসায়িক জ্ঞান দিয়ে সাহায্যও করে থাকি। আমার জানামতে এমন কোনো কর্মক্ষেত্র নেই, যা পুরোপুরি নারীশাসিত। তা সে আমার কাজের ক্ষেত্র প্রকৌশল হোক বা অন্য যেকোনো জায়গা। এমন অনেক সফটওয়্যার কোম্পানি দেখেছি যাতে পুরুষের সংখ্যা নারীর চেয়ে বেশি। আমি নিজে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু কই, নারী প্রকৌশলী পরিচালিত কোনো সফটওয়্যার ফার্ম তো দেখতে পাই না। আমার কাজ শুরুর সময়ে পরামর্শ বা দিক-নির্দেশনা নেওয়ার লোকের হয়তো কমতি ছিল না। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে এমন কোনো নারী ব্যক্তিত্ব পাইনি, যাদের কাছ থেকে পথনকশা পাব।'

হুমায়রা আক্তার অন্তরা : কারাতে প্র্যাকটিশনার এবং অ্যাথলেট অন্তরা। অন্তরা বলেন, আমি কারাতে শিখতে শুরু করি, কারণ আমি স্বাধীন হতে চেয়েছিলাম। বড় হওয়ার সময়টাতে আমি আমার বাবাকে পাইনি। পরিবারে ছিল মা ও বোনেরা। পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব ছিল। মানুষজন আমাকে পড়াশোনা করতে সাহায্য করে, কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি বুঝতে শিখি যে এভাবে জীবন কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন পরনির্ভর জীবন আমি চাই না। এভাবেই এই যাত্রা শুরু। আমরা তখন পল্টনে থাকতাম, আর বাসার খুব কাছেই ছিল ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল (এনএসসি)। এনএসসিতে মার্শাল আর্ট, জিমন্যাস্টিকসের চর্চা ছিল। আমার মাথায় চিন্তা এলো, আমি যদি এসব খেলাধুলায় অংশ নিতে পারি, তাহলে আমি আরো আত্মনির্ভরশীল হতে পারব। তাই আমি মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নেয়া শুরু করলাম। প্রথমদিকে নারীদের ক্ষেত্রে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যেমন হয়, আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। বহু সংশয়, প্রশ্ন আর বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হলাম। কিন্তু আমাকে এসব কিছুই থামিয়ে দিতে পারেনি।

২০১৯ সালে আমি যখন সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জিতি, তখন এসব কথা কানে আসাও বন্ধ হয়ে গেল। এমনকি যারা আমাকে একসময় হেয় করেছিলেন, তাদের মুখেও প্রশংসা শুনতে পেলাম। আমার সঙ্গে সেবার আরও দুজন স্বর্ণপদক জিতেছিল এবং তাদের মধ্যে একজন নারী, একজন পুরুষ। জয়ের অনুপাতে কিন্তু নারীরাই এগিয়ে। এরপর আমি অবশ্য এই ক্ষেত্রটাতে বহু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছি এবং আমি নিশ্চিত যে নারীরা এভাবেই এগিয়ে আসবে ও নিজেদের মেধার ছাপ রেখে যাবে।'

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঘন কুয়াশায় এক্সপ্রেসওয়েতে ৭ যানবাহনের সংঘর্ষ, আহত ৫

আইনজীবী আলিফ হত্যা : তদন্ত কমিটির সব সদস্যের পদত্যাগ 

আজও খুব অস্বাস্থ্যকর ঢাকার বাতাস

বাংলাদেশের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত 

সমালোচনার পর কমলো বিপিএল মিউজিক ফেস্টের টিকিটমূল্য

ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩৮