প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দাওয়াতের মেহনত
উদয়ু ইলা সাবিলি রাব্বিকা বিল হিকমাতি ওয়াল মাওইজাতিল হাসানাহ (সূরা নাহল, আয়াত-১২৫)। মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেন , ‘আপনি মানুষকে আপনার রবের পথে আহ্বান করুন হিকমত ও সদুপদেশ দিয়ে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা করুন মিষ্টি কথায়’।
আয়াতে আল্লাহ পাক মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার মাধ্যম বলে দিয়েছেন, আমাদের বোঝা দরকার হিকমত কী? হিকমত অর্থ কৌশল। আল্লাহর রাসূল (সা.) সর্বপ্রথম দ্বীন প্রচার করলেন ব্যক্তিগত দাওয়াতের মাধ্যমে। প্রথমেই তিনি আম্মাজান খাদিজাতুল কোবরা (রা.)কে দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানালেন। তারপর এক এক করে মক্কা ও মদিনার অন্যদের কাছে দ্বীনি দাওয়াত পৌঁছান।
হিজরতের পর নবী (সা.) দাওয়াতের নতুন একটি মাধ্যম গ্রহণ করেন পত্র। নবী (সা.) এক এক করে হাবসা বাদশাহ নাজ্জাশী, রোমের বাদশাহ কায়সার, পারস্য বাদশাহ কিসরাসহ সব রাষ্ট্র প্রধানের কাছে পত্র পাঠিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। আল্লাহর রাসুল দ্বীন প্রচারে যোগাযোগ মাধ্যমের সর্বোচ্চ সময়োপযোগী ও বৈপ্লবিক কৌশলটি ব্যবহার করে ইসলামের মহান অগ্রযাত্রাকে অগ্রসর করেছিলেন।
নবীজীর দ্বীন প্রচারের এ নতুন মাধ্যম আমাদের শিক্ষা দেয় কিয়ামত পর্যন্ত যোগাযোগের যতগুলো পদ্ধতিই আবিষ্কার হবে সব মাধ্যমেই দ্বীনের প্রচার করা মুসলমানদের ওপর অবশ্য কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে আমরা নিতে পারি। তবে সতর্কতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি। বিজ্ঞানের উন্নতির এই যুগে দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার।
আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে অল্প সময়ে কম কষ্টে অসংখ্য মানুষের নিকট দ্বীনি দাওয়াত দেওয়া খুব সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক মাধ্যমগুলোতে ইসলামের সহীহ আকিদার মানুষ কম আসায় এ ক্ষেত্রে সুযোগ নিয়ে নিচ্ছে ভ্রান্ত একটি দল বা গোষ্ঠি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের কল্যাণে বিশ্ব এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। দ্বীনি দাওয়াতের পদ্ধতি একদিকে যুগোপযোগী উন্নত মানের হওয়া দরকার অন্যদিকে সমকালীন বাতিল শক্তির মোকাবিলা করার মতো যোগ্যতা, দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগের সক্ষমতা থাকা জরুরি।
আধুনিক বিশ্বে দ্বীনি দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম ওয়েবসাইট, ওয়েব পোর্টাল ও অনলাইনে ফ্রি বই প্রকাশ করে, স্কানিং কপি আপলোড করা বা বিজ্ঞাপনে ইসলামী ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে। তাছাড়া আরো রয়েছে ব্লগ; যা দ্বীনি দাওয়াত দেওয়ার জন্য অন্যতম একটি মাধ্যম। বর্তমান সময়ে ইসলামের সুমহান বাণী লিখে দ্বীনি দাওয়াতের ব্যাপক ভূমিকা পালন করা যায়। এই ব্লগের মাধ্যমে।
তাছাড়া আরো রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকে ইসলামের বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াতের মাধ্যমে সাওয়াব হাসিল করা যায়। দ্বীনি দাওয়াতের ক্ষেত্রে বিশেষ আরো একটি মাধ্যম হলো ইউটিউব বা এর নিজস্ব চ্যানেল তৈরি; যার মাধ্যমে জুমার খুতবা, বিভিন্ন স্থানসমূহের দৃশ্য এবং নিজের কিছু ধর্মীয় আলোচনা করে মানুষকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় আরো রয়েছে টেলিভিশন ও রেডিও; এখানে ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াত দেওয়া যেতে পারে।
অনলাইন পত্রিকা, সমাজ পরিবর্তন ও সমাজের ভালো কিছু প্রচলনের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা স্থায়ী ভূমিকা রাখতে পারা প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে ইসলামী কলাম লিখে দ্বীনি প্রচারের বিশেষ ভূমিকা পালন করা যায়। বর্তমানে কোরআন ও হাদিস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন সফটওয়্যার, যা যেকোনো বিষয়ে জানতে সহজ করে দেয়। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে দ্বীনি দাওয়াত দেওয়ার জন্য হাতের মুঠোয় গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল।
আরও পড়ুনএই মোবাইলে ইসলামবিষয়ক অ্যাপসমূহ, বিভিন্ন অনুবাদ, মাসয়ালাসহ বিভন্ন তথ্যসমূহ রেখে অন্যকে পড়ার সুযোগ করে দিয়ে দ্বীনি দাওয়াত প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক প্রযুক্তিতে ইসলামী দাওয়াত প্রদান করা তথা সৎ কাজের আদেশ প্রদান করা ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদান করা সব মুসলমানের ওপর অবশ্য কর্তব্য। উম্মতে মুহাম্মাদির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দাওয়াত, আদেশ-নিষেধ, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা নসিহতের দায়িত্ব।
এই দ্বীনি দাওয়াত যে ব্যক্তি পালন করবে, সে সফলতা অর্জন করবে। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভালো কাজের আদেশ দিবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে আর তারাই সফলকাম, (সুরা ইমরান : আয়াত-১০৪)।’ দাওয়াতি কাজ শুধুমাত্র খানকা, মসজিদে, সংগঠনে, ওয়াজ মাহফিলে ও লেখালেখির কাজে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। বর্তমানে ডিজিটাল তথ্যপ্রযুক্তির যুগ, তথ্য প্রযুক্তির যুগে অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে তাদের ধর্মীয় কাজ সারা বিশ্বে মুহূর্তে প্রচার করছে, তাদের তুলনায় আমরা মোটেও পারছি না।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ব্যাপকহারে প্রচার করার জন্য ইহুদিদের রয়েছে প্রায় সাড়ে আট লাখেরও বেশি ওয়েবসাইট। খ্রিস্টানদের প্রচারণায় রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখের বেশি এবং অন্যান্য অমুসলিমদের রয়েছে প্রায় চার লাখের বেশি ওয়েবসাইট। তারা তাদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক, টুইটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুসলমানদের নিকট তাদের দাওয়াতি কাজ করছে। অমুসলিমদের নিকটে দ্বীনি দাওয়াতের কারণে অমুসলিম দেশে ক্রমেই মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুসলিম অমুসলিম ব্যক্তিকে দাওয়াত দিলে মানুক বা না-ই মানুক, ফায়দা হোক বা না হোকÑ নিজের ফায়দা হবে। অন্যের ঈমান আমল দোরস্ত করার কাজে সহযোগিতা করলে আল্লাহ নিজের আমাল দোরস্ত করে দেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন বান্দা আরেকজন বান্দার সাহায্য করে থাকলে আল্লাহপাকও তার সাহায্য করে থাকবেন। অন্যের ঈমান আমলের কাজে সাহায্য করলে আল্লাহপাক নিজের ঈমান আমলের ফায়সালা করে দেবেন, (মুসলিম শরিফ)।’
দ্বীনি দাওয়াত দেওয়া প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তার আওতাধীন সকল ব্যক্তির ওপর দেওয়া আবশ্যক। পরিবারের কর্তার জন্য তার স্ত্রী, সন্তানদের দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে ইসলামের শরিয়া মোতাবেক পরিচালনা করা, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলের প্রধানগণ তার সহকারী ও শিক্ষার্থীদের, মিল ফ্যাক্টরি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকগণ তার অধীনস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের, এলাকার শাসকগণ যার যার অধীনস্ত সবাইকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ প্রদান করে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয়ের জন্য দাওয়াত দেবেন।
কেননা, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই জিম্মাদার এবং তোমাদের প্রত্যেককেই অধীনস্তদের ব্যাপারে জিজ্ঞাস করা হবে, (বুখারি শরিফ)।’ মহান আল্লাহ্ আমাদের কে কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন যাপন করার জন্য তৌফিক দান করুন। আমীন
লেখক : তরুণ আলোচক ও গবেষক
সচিব দাওয়াত : কুরআন মজলিস, বগুড়া জেলা
সদস্য : জাতীয় মুফাছছির পরিষদ বগুড়া জেলা
kmaminuliu@gmail.com
মন্তব্য করুন