শাওন রহমান: বগুড়া সদরের সাবগ্রাম এলাকার খামারি মো. হাসান। দীর্ঘ দুই যুগের পোল্ট্রি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন গত বছরের মাঝামাঝিতে। নিজের জমিতে কৃষি কাজের পাশাপাশি এখন ছোটখাটো অন্য ব্যবসা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই খামারি বলছেন, দুই যুগের বেশি সময় ধরে পোল্ট্রি ব্যবসা চালানোর পর গত তিন বছর টানা লোকসানে খামারে মুরগি তুলতে আর সাহস পাইনি।
মুরগি প্রতিপালনের সাথে সম্পর্কিত সব কিছুর দাম প্রতি বছরই বাড়ে, কিন্তু মুরগি ও ডিমের দাম নানা কারণে উল্টো কমে যায়। আর কত লোকসান করব? তাই বাধ্য হয়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছি। পৌর এলাকার রবিবাড়িয়া এলাকার খামারি সাজেদুর রহমান বলছেন, খামার বন্ধ করেছি দেড় বছর হলো।
করনোকালীন যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে না পেরেই খামার বন্ধ করে দিয়েছি। আর এখন খামারে মুরগির বাচ্চা তুলতে যে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে এবং প্রতিপালন আনুষাঙ্গিক খরচ যেভাবে বেড়েছে তাতে এ ব্যবসায় আর ফিরব না। হাসান, সাজেদুরের মতো বগুড়ার অনেক প্রান্তিক ও মাঝারি খামারি লোকসান পোষাতে না পেরে তাদের পোল্ট্রি খামার বন্ধ করে দিয়েছেন।
বগুড়া পোল্ট্রি ওনার্স এসোসিয়েশনের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বগুড়ায় ছোট-বড় মিলে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ২শ’। বিগত কয়েক বছরে বিশেষ করে করনাকালীন ও তা পরবর্তী বগুড়ার পোল্ট্রি খামার কমে অর্ধেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮শ’তে। খামার বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ জানাচ্ছেন, দফায় দফায় মুরগির খাবারের দাম, ওষুধ, পরিবহণ খরচ ও খামার সম্পৃক্ত নানা উপকরণের দাম বৃদ্ধি এবং সাম্প্রতিক বিদ্যুতের বাড়তি খরচের কারণে এ খাত প্রান্তিক ও মাঝারি খামারিদের জন্য ধারাবাহিক লোকসান পরিণত হয়েছে।
এদিকে প্রাণিজ আমিষের সহজলভ্য উৎস ফার্মের এসব ডিম ও মুরগি। গত তিন দশ ধরে গ্রামগঞ্জের প্রান্তিক খামারিরা জোগান দিয়ে আসছেন আমিষের চাহিদা। গরিবের খাবারের পাতে সস্তায় যারা ডিম-মুরগি তুলে দিয়েছেন আজ তারাই নানা সংকটে।
নানা সংকটে লোকসান গুণতে গুণতে প্রান্তিক খামার যখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বাজারে এসব পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় ঠকছেন ক্রেতারা।
খামারির কষ্টের লাভ আর সাধারণ ভোক্তার টাকা লুটে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী, বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। এতে স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের প্রতিদিনের আমিষ গ্রহণে কাটছাঁট করছেন। ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
প্রান্তিক খামারিরা বলছেন, প্রাণিজ খাদ্য ও ওষুধের দাম এবং জ্বালানি তেলের খরচ বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট এবং কর্পোরেট কোম্পানির বড় বিনিয়োগে চাপের মধ্যে আছেন তারা।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন তথ্যমতে, দেশে ১ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৯ খামারের মধ্যে এখন চালু আছে ৯৫ হাজার ৫২৩টি। বর্তমানে উৎপাদন (মুরগির মাংস) হচ্ছে ৪ হাজার ২১৯ টন, যা উৎপাদন সক্ষমতা থেকে ২৫ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। এ ছাড়া ডিম উৎপাদন সক্ষমতা দৈনিক যেখানে ৬ কোটি ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ১৮৩টি, সেখানে দৈনিক মিলেছে ৪ কোটি ৩২ লাখ ১৩ হাজার ৪১৮টি, যা উৎপাদন সক্ষমতা থেকে ২৫ শতাংশ কম।
বগুড়া পোল্ট্রি ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি নূরুল আমিন লিডার বলেন, প্রতি বছরের শীতের শেষে ও গরমের শুরুতে পোল্ট্রি খামারিদের ভালো-মন্দ মিলেই কাটে। মূলত এই সময়টাতে বাজারে পোল্ট্রি পণ্যের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকায় টিকে থাকা খামারিরা তাদের পণ্যের বেশ ভালো দাম পান। বিপরীতে অনেক খামারি শীত-গরমের মাঝে তাদের মুরগি ধরে রাখতে না পেরে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন।
তিনি জানান, ২০২০ সালের পর প্রতি ৫০ কেজির মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে ৯শ’ থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত, সেই অনুপাতে ডিম-মুরগির দাম বাড়েনি। বর্তমান ডিম-মুরগির যে দাম তা সাময়িক। এ দামে খামারিরা খরচ তুলতে পারলেও মূলত লাভবান হচ্ছেন বহুজাতিক কোম্পানি, বড় কর্পোরেট হাউজ ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা, ক্ষতগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা।
এ দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসলেও মুরগির খাবার, ওষুধ, ডিজেল ও বিদ্যুতের দামতো আর কমবে না, ফলে এ খাতের সংকট সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ ছাড়া কখনও দূর হবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।