ভিডিও

গ্লোবাল ক্রাইসিস : বৈশ্বিক উষ্ণতার মহাসড়কে বিশ্ব

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ০৮:০০ রাত
আপডেট: অক্টোবর ১৫, ২০২৪, ০৮:০০ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

মো. খবির উদ্দিন : বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি একটি ভয়াবহ সমস্যা যা আমাদের গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। পৃথিবীর জলবায়ুর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঘটনা যা প্রাথমিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং বন উজাড়ের মতো মানুষের ক্রিয়াকলাপ দ্বারা সৃষ্ট। শিল্প বিপ্লব, অস্ত্র বিপ্লব আমাদেরকে অথৈ সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার মিছিলে তাড়িয়ে নিচ্ছে। হেরিকেন, টাইফুন, টর্ণেড, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝাট, জলোচ্ছ্বাস পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার অশনিসংকেত। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা, সাগরের পানির গড় লেয়ার, সবুজায়নের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার, জমে থাকা বরফের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার একাউন্টিবিলিটি নিয়ে এখনই সিরিয়াস হতে না পারলে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়ে যাবে বিশ্ব। সবুজায়ন ধ্বংস ও শিল্প বিপ্লবের ফলে অতিমাত্রায় খরা, ঝড় জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ নড়েচড়ে বসা শুরু করেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে এই স্লোগানে বিশ্ববাসীকে একত্রিত করতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার কারণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছেন, “এখনই কিছু করুন নাহলে সংকটের ঝুঁকিতে থাকুন”।           গোটা পৃথিবী অতি বিপ্লবী হয়ে আত্মহত্যার মত এক মহাসড়কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মত সাগর তীরবর্তী দেশগুলো রয়েছে ভূখন্ড হারাবার ঝুঁকিতে। পানির লেয়ার বেড়ে গিয়ে লোকালয়ে ঢুকে যাবে লোনা পানি। সাগরের পানির লেয়ার বেড়ে খেয়ে ফেলবে ভূখন্ডের বিশাল এলাকা। এ সংক্রান্তে বিশ্ববাসী একের পর এক সম্মেলন করে যাচ্ছে কিন্তু অগ্রগতি নিয়ে রয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন।

দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিপর্যয় ৪০ শতাংশ বাড়বে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ক দপ্তর ‘ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন’ বা ‘ইউএনডিআরআর’ এ পূর্বাভাস দিয়েছে খবর সিনহুয়ার। গত ২২.০৮.২০২৪ বৃহস্পতিবার ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস সম্পর্কিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন এপিএমসিডিআরআর ২০২৪ এর উদ্বোধন হয়।  উদ্বোধনী বক্তব্যে ইএনডিআরআরের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান মার্কো তোসকানো-রিভলতা বলেন, এ শক্তিশালী অনুমান ইঙ্গিত দেয় যে, ২০১৫ সালে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য বিশ্বব্যাপী সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম, আমরা তা থেকে সরে যাচ্ছি।

সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডিজাষ্টার রিস্ক রিডাকশন’ একটি বৈশ্বিক চুক্তি, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় (প্যাসিফিক) অঞ্চলের দেশগুলোকে দুর্যোগ পরিকল্পনা, মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে সহায়তার উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। আঞ্চলিক দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি ও সাড়া দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে রিভালতা বলেন, মৌলিক বিষয় হচ্ছে, আমাদের দুর্যোগ মোকাবিলা ও ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম দ্বিগুণ করতে হবে। 

দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে সম্মিলিত পদক্ষেপ ত্বরান্বিত করতে ফিলিপাইনে আগামী অক্টোবরে এপিএমসিডিআরআর সদস্যদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি টেকসই ও প্রত্যাশিত অর্থায়ন নিশ্চিত করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক ঝুঁকি হ্রাস, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের সমন্বয় এবং আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, যারা বেশি মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করছে, তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর সুস্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। অন্যথায় বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়ের ঝুঁকি তৈরি হবে। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গায় ৫৩তম ‘প্যাসিফিক আইল্যান্ড ফোরাম লিডার্স মিটিং’ এর ফাঁকে বিবিসিকে কথাগুলো বলেন গুতেরেস।

তিনি বলেন, ‘প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আজ বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এই অঞ্চল ঘিরে ব্যাপক অবিচার করা হয়েছে। সে কারণেই আজ আমি এখানে এসেছি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি নিয়ে আলাদা দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এই উচ্চতা বৃদ্ধি কীভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোকে হুমকির মধ্যে ফেলেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

ফোরামে বক্তব্য দেয়ার সময় গুতেরেস বলেন ফুঁলেফেঁপে ওঠা সমুদ্র আমাদের সবার দিকে আসছে। সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, কারণটা পরিষ্কার, গ্রিনহাউস গ্যাস। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে বিপুল পরিমাণে এই গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এটি আমাদের গ্রহকে দগ্ধ করছে। এই উষ্ণতার প্রভাব পড়ছে সাগরে। বিশ্বে গত ৩ হাজার বছরের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা নজিরবিহীনভাবে বাড়ছে বলে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।  এর মধ্যে গত ৩০ বছরে গড়ে উচ্চতা বেড়েছে ৯ দশমিক ৪ সিন্টিমিটার। সেখানে গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর বৃদ্ধি হয়েছে ১৫ সেন্টিমিটার।

ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আরও বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের মহাসড়কে চলছে বিশ্ব এবং এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। মিসরে জড়ো হওয়া বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখন শুধু দু’টি পথ খোলা, আত্মহত্যা নয়ত সমন্বিত পদক্ষেপ। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ টোয়েন্টি সেভেনে অংশ নিতে মিসরে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা। তাদের লক্ষ্য, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে ধরিত্রীকে রক্ষার সমন্বিত পদক্ষেপ। জীবাশ্ম জ¦ালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের আহ্বান উঠে এসেছে বিশ্ব নেতাদের কণ্ঠে। জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় এবার প্রথমবারের মত এজেন্ডা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ক্ষতিপূরণ তহবিল। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। 

অন্যদিকে NASA Earth Observatory এর তথ্য মতে,  ১৯৫১-১৯৮০ এর তুলনায় ২০০০-২০০৯ পর্যন্ত ১০ বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নির্দেশ করছে। উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে । কৃত্রিম উপগ্রহকৃত তাপমাত্রা পরিমাপ হতে দেখা যায় যে, নিম্ন ট্রপোমন্ডলের তাপমাত্রা ১৯৭৯ থেকে প্রতি দশকে ০.১২ ডিগ্রি সে.-০.২২ ডিগ্রি সে. সীমার মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৫০ সালের এক বা দুই হাজার বছর আগে থেকে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল, তাছাড়া সম্ভবত মধ্যযুগীয় উষ্ণ পূর্ব কিংবা ক্ষুদ্র বরফযুগের মত কিছু আঞ্চলিক তারতম্য ঘটেছিল। 

বিজ্ঞানিদের ধারণামতে সৌরমন্ডলে পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটার ও তা টিকে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। আমাদের এই পৃথিবী মূলত বাতাস ও পানির উপস্থিতির কারণেই অন্যান্য গ্রহের চেয়ে এতটা আলাদা। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে ঘিরে রেখেছে বায়ুমন্ডলের পাতলা একটি স্তর। এই বায়ুমন্ডলের ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন ও ২১ শতাংশ হলো অক্সিজেন। বাকি শতকরা ১ ভাগের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্গন, মিথেন, ওজোন, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি অসংখ্য বায়বীয় পদার্থ, আর পানি ও কণাপদার্থ। সূর্যরশ্মির অধিকাংশই ভূমন্ডলে প্রবেশ করে; কিন্তু এর কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠে ও বায়ুস্তরে প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যায়। সূর্যের আলো যতটুকু বায়্মুন্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে পৌঁছায়, এর একটি অংশ ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলে। তারপর ভূপৃষ্ঠ ঠান্ডা হতে থাকে, তখন শোষিত তাপটুকু অবলোহিত রশ্মি হিসেবে বায়ুমন্ডলে বিকিরিত হয়।

বিজ্ঞানিরা আরও বলেন, পৃথিবীর বায়ুস্তরে কিছু গ্যাসীয় উপাদান ও কণাপদার্থ আছে। এগুলো বিকিরিত তাপকে শুষে নেয় এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুস্তর অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারকে উষ্ণ করে তোলে। আর এই প্রক্রিয়াই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী উষ্ণতা বজায় রাখে এবং জীবজগৎকে সুরক্ষিত রাখে। ঠিক একটি গ্রিনহাউসের মতো। এককথায় একেই বলে গ্রিনহাউস এফেক্ট। আর তাপ শোষণ ও ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা পালন করে বলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, ওজোন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি বায়বীয় পদার্থকে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নামে ডাকা হয়।

ভূপৃষ্ঠের বর্তমান গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিনহাউস এফেক্ট যদি না থাকত, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হতো মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই যদি হতো পৃথিবীর বুকে তরল আকারে পানির অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের গঠন ও গ্রিনহাউস এফেক্টে সেটা হয়নি। আর এ কারণেই পৃথিবীর বুকে লাখ লাখ জীবনের উদ্ভব ঘটে চলেছে এবং তারা টিকেও থাকতে পারছে।

গ্রিনহাউস প্রভাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের বা বিতর্কের অবকাশ নেই। অর্থাৎ গ্রিনহাউস এফেক্টের অনুপস্থিতিতে জীবনের অস্তিত্বই অসম্ভব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমন্ডলের অধিক তাপশোষী কিছু গ্রিনহাউস গ্যাস ও কার্বন কণার (যেমন ব্ল্যাক কার্বন) পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানা থেকে নিঃসৃত ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা, সার্বিক জীবনযাত্রার মান ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আগ্রহ। নগরসভ্যতা বিস্তারের পাশাপাশি যানবাহন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন নিশ্চিত করতে যথেচ্ছভাবে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত জীবাশ্ম জ¦ালানি। এতে উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও ব্ল্যাক কার্বনের মতো তাপশোষী গ্যাসীয় ও কণাপদার্থ। এসব উপজাত প্রতিমুহূর্তে বাতাসে মিশে যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। এদিকে কৃষিকাজ, পশুচারণ, নগরায়ণ ও আরও নানা উদ্দেশ্যে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করার মতো গাছপালার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। আর এভাবেই বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। এই বিষয়টিকে এককথায় বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য, উপাত্ত ও মডেলনির্ভর জটিল হিসাব-নিকাশে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮০ সাল অর্থাৎ, শিল্পবিপ্লবের কিছুকাল পর পর্যন্তও বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ২৬০-২৮০ পিপিএমের (পার্টস পার মিলিয়ন) মধ্যে ওঠানামা করেছে। কিন্তু ১৯৮৯ সাল নাগাদ সেই মাত্রা নিরাপদ সীমা (৩৫০ পিপিএম বা মিলিগ্রামে পার লিটার) ছাড়িয়ে গেছে। সঙ্গে পৃথিবীর বার্ষিক গড় তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিটি বছরই তার আগের বছরের তুলনায় বেশি উষ্ণ হয়ে উঠেছে। তবে মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে ওজোন স্তরে ক্ষয়ের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটে বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে ১৪ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে এই পরিবর্তন সীমাবদ্ধ থাকে। আর ওজোন স্তরের অবস্থান হচ্ছে বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারের সংলগ্ন এর পরের স্তর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অর্থাৎ, ১৪ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়। মূলত মানুষের তৈরি ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের ফটোকেমিক্যাল বিক্রিয়ার কারণে ওজোন স্তরে ক্ষয় হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সামুদ্রিক ঝড় বেড়ে গেছে। পৃথিবীর শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা হচ্ছে। আর্দ্র অঞ্চলগুলো হয়ে পড়ছে আগের চেয়ে শুষ্ক। এ ধরনের পরিবর্তনগুলোকে এককথায় বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফস্তর বা হিমালয়-আল্পসের মতো পর্বতমালার হিমবাহ অথবা সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল খন্ডগুলো গলে যাচ্ছে। গবেষকগণ ও পরিবেশবিদরা বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করছেন এবং মানব সচেতনতা, গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া ইত্যাদি রোধ, সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালের পর থেকে পৃথিবীর সাগরগুলোর পানির লেয়ার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করবে এবং সাগর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে নোনা পানি ঢুকতে শুরু করবে। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে জনপদগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি বিরাট অঞ্চল এ ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনের পুনর্বাসন ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার মহাসড়ক থেকে পৃথিবীকে ঊনিশ শতাব্দির আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হলে বিশ্ব নেতৃত্বের সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা উপায় খুঁজে নিতে পারি। বেঁচে থাকার বিপ্লবে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে, সবুজায়নের বিপ্লব ঘটাতে হবে। কলকারখানায় পরিবেশবান্ধব ইঞ্জিন ব্যবহারে আপোষহীন হতে হবে। আল্লাহ প্রদত্ত এ নেয়ামত রক্ষার্থে সকল বিশ্ববাসীকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। একইসাথে পৃথিবীর সকল মানুষের অভিন্ন অস্তিত্ব ভেবে পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। হয় সমন্বিত পদক্ষেপ নয়ত আত্মহত্যা, বিষয়টি নিশ্চিত জেনে পৃথিবীর সকল নেতৃত্ব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে আমরা অবশ্যই এই বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে পরিত্রাণ পাব ইনশাআল্লাহ্।

লেখক : কলামিস্ট
Email: khobir72@gmail.com
০১৭১১-২৭৩২৮০



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS