ভিডিও

সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা

অবশেষে নড়েছে টনক 

মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণে জটিলতা 

প্রকাশিত: জুন ০১, ২০২৪, ১০:১০ রাত
আপডেট: জুন ০২, ২০২৪, ১০:১০ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

করতোয়া ডেস্ক : নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন নোয়াখালীর ইউসুফ। অন্তত পাঁচ মাস আগে রিক্রুটিং এজেন্সিকে পুরো টাকা শোধ করলেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি মালয়েশিয়ায়। গত দুই দিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে শেষমেষ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছেন। এই টাকা কীভাবে উদ্ধার করবেন, তা নিয়ে এখন তিনি দুশ্চিন্তায় পার করছেন দিন। 
ইউসুফের মতো এ রকম স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশি। তবে তাদের প্রকৃত সংখ্যা এখনও কেউ নিরূপণ করতে পারেনি। শেষ মুহ‚র্তে কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠাতে শুক্রবার পরিচালনা করা হয়েছে বিশেষ ১২টি ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটে অন্তত ২ হাজার কর্মী সেদেশে গেছেন বলে জানিয়েছে বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক। 

* এজেন্সির গাফিলতিতে স্বপ্নভঙ্গ হাজারো কর্মীর
* কর্মীদের নেওয়ার চেষ্টা চলছে : হাইকমিশনার
* এজেন্সির লাইসেন্স স্থগিতের খবরটি সত্য নয়
* চার এমপির রমরমা টিকিট বাণিজ্য!

শুক্রবার বিমানবন্দরে বিভিন্ন এজেন্সির ইস্যু করা ভুয়া টিকিট নিয়ে হাজির হয়েছেন অনেক কর্মী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়া যেতে এজেন্সিকে ৫-৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে অন্তত ৬-৭ মাস আগে। এতদিনেও এজেন্সি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। শেষ মুহ‚র্তে ভুয়া টিকিট ইস্যু করে তাদেরকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে টিকিটগুলো ভুয়া। এ অবস্থায় প্রায় ৩০ হাজার কর্মীর যাওয়া হয়নি মালয়েশিয়ায়। এ নিয়ে গত দুই দিন সারাদেশে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। 
এদিকে হাজারো শ্রমিকের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার পর টনক নড়েছে কর্তৃপক্ষের। মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে যে বা যারা সংকট সৃষ্টি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি হবে এবং সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। শনিবার দুপুরে সিলেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা পরিদর্শন এবং একটি মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। 
৩১ মের পর আর কোনো শ্রমিক নেওয়া হবে না সেই ঘোষণা মালয়েশিয়া আগেই দিয়েছিল। যারা নিবন্ধন করেছেন এবং ভিসা পেয়েছেন তাদের ৩১ মের মধ্যে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছিল দেশটি। তবে শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি। কয়েক হাজার শ্রমিক টিকিট ছাড়াই বিমানবন্দরে ভিড় করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের অনেকের কাছেই মালয়েশিয়ায় যাওয়ার স্বপ্ন অধরা রয়ে যায়। 
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করতে না পারার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এই সংকট তৈরির পেছনে যে বা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 
বায়রার ওপর দোষ চাপিয়ে শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, মালয়েশিয়ায় পাঁচ লাখের উপরে কর্মী প্রেরণের জন্য দেশটির সরকার কোটা দিয়েছিল। সেই কোটা পূরণে কাজ করেছিল বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার সাথে কথা বলে কাদের ভিসা হয়েছে আর কাদের ভিসা হয়নি সেই তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বায়রা সেই তালিকা দিতে পারেনি। ফলে ফ্লাইটের সমস্যা হয়েছে। 
সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পরবর্তী সময়ে কর্মী পাঠানোর জন্য ২২টি বিশেষ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। একইসঙ্গে মালয়েশিয়া সরকারকে সময় বাড়ানোর জন্যও চিঠি প্রেরণ করা হয়েছে। তবে এখনো সেই চিঠির উত্তর আসেনি। 
সমস্যা সমাধানে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার চায় বৈধপথে শ্রমিক বিদেশে যাবে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাবে। আমাদের উদ্দেশ্য হয়রানি করা না, যারা হয়রানি করছে তাদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 
প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালে বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার, আট বছর পর তা চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে ফের ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেয় মালয়েশিয়া। ২০২১ সালের ১৮ ডিসেম্বর নতুন সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে সেই বাজার খুলতে সময় লেগেছিল তিন বছর। ২০২২ সালের আগস্টে দেশটিতে আবারও বাংলাদেশি কর্মী যাওয়া শুরু হয়। 
মালয়েশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ জুন থেকে বাংলাদেশসহ বিদেশি কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশ বন্ধ থাকবে। নতুন নিয়মে কর্মী পাঠাতে হলে আবারও সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। গত জানুয়ারি মাসে মালয়েশিয়ার মন্ত্রিপরিষদ ১৫টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি আবার রিভিউ করার অনুমোদন দিয়েছে। দেশটি বর্তমানে থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, লাওস, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে শ্রমিক নিয়ে থাকে।
৩ থেকে ৪ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি : বায়রা মহাসচিব : বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব বলেছেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্তে¡ও টিকিট না পাওয়ায় তিন থেকে চার হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। শনিবার গণমাধ্যমকে তিনি এ কথা জানান। তবে সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভিসা পেয়েও বিমানের টিকিটসহ নানা জটিলতায় আটকা পড়েন ৩০ হাজারের বেশি কর্মী। সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা হলেও মালয়েশিয়া যেতে এই কর্মীদের বেশিরভাগেরই গুনতে হয়েছে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, শনিবার আমাদের অফিস বন্ধ থাকায় কতজন বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় গেছেন এবং কতজন সেখানে যেতে পারেননি তার চ‚ড়ান্ত সংখ্যা আমরা এখনও পাইনি। আমরা রোববার বলতে পারব। বায়রা মহাসচিব বলেন, কুয়ালালামপুরে পৌঁছানোর সময়সীমা শুক্রবার শেষ হওয়ায় এবং তাদের কাছে উড়োজাহাজের টিকিট না থাকায় প্রায় তিন থেকে চার হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। 
কর্মীদের নেওয়ার চেষ্টা চলছে : হাইকমিশনার : যেসব কর্মী মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন তাদের নিয়োগকর্তারা রিসিভ করতে দেরি হওয়ায় প্রায় ২০ হাজার কর্মী আটকা পড়েছিলেন। শনিবার সকালে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের অবস্থা স্বাভাবিক হয়। কর্মীরা নিজ নিজ কোম্পানির কর্মস্থলে যোগ দেন। কিন্তু শেষ মুহ‚র্তে ভিসা পেয়েও মালয়েশিয়া যেতে পারেননি প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী। তাদের দ্রæত মালয়েশিয়ায় নেওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শামীম আহসান। শুক্রবার  রাতে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পরিদর্শন শেষে এ কথা বলেন তিনি। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, যারা ভিসা পেয়ে মালয়েশিয়ায় আসতে পারেননি, তাদের নিয়ে আসার ব্যাপারে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, যেন তাদের দ্রæত নিয়ে আসা যায়। 
তিনি বলেন, পাঁচ লাখ ২৭ হাজারের বেশি ডিমান্ড লেটার সত্যায়ন করেছি। এ পর্যন্ত চার লাখ ৭২ হাজারের বেশি কর্মী মালয়েশিয়াতে এসেছে। আমরা নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, তারা যেন এসে এখানে কাজ পায়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে শুক্রবার রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন রাষ্ট্রদূত মো. শামীম আহসান। 
চার এমপির রমরমা বাণিজ্য! : মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের নিয়ন্ত্রণে জনপ্রতিনিধিসহ গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে। বছরের পর বছর সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালীরা প্রতারণা করলেও জড়িতরা থাকছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বছরের পর বছর নিউ হ্যাভেন, এলিগেন্ট, আল ফারাহসহ হরেক নামের এজেন্সির প্রতারণা অব্যাহত থাকলেও অদৃশ্য কারণে হয়নি প্রতিকার। পর্দার আড়ালে কুশীলবদের মাঝে আছেন সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালীরা। যাদের হাতের ইশারায় ভাগ্য বদলায় শ্রমবাজারের, সেখানকার কর্মীদের। অনুমোদন পেয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও শুক্রবার শেষ দিনে প্রায় ৩০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। এতে গড়ে ৫ লাখ টাকা করে হলেও এজেন্সিগুলোর পকেটে গেছে দেড় হাজার কোটি টাকা। 
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে মূলত রমরমা ব্যবসা করছেন বর্তমান ও সাবেক চার সংসদ সদস্য। তাদের মধ্যে অন্যতম মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) টিকিটে ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য হন তিনি। ফাইভএম ইন্টারন্যাশনাল নামের এজেন্সির মাধ্যমে তিনি মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে থাকেন। 
এই তালিকায় নাম আছে ফেনী-২ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) নিজাম উদ্দিন হাজারীর। তিন বার সংসদে যাওয়া এই জনপ্রতিনিধি স্নিগ্ধা ওভারসিজ নামের এজেন্সি পরিচালনা করেন। 
ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদ পরিচালনা করেন আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল নামের এজেন্সি। আর সাবেক অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা-১০ আসনের সংসদ সদস্য আহম মুস্তফা কামালের স্ত্রীর নামে চলে অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ নামের এজেন্সি। 
দুর্নীতি অনিয়ম, সিন্ডিকেটের কারণে এ পর্যন্ত চার বার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করতে বাধ্য হয় মালয়েশিয়া সরকার। বাংলাদেশি সিন্ডিকেটের কাছে নিজেদের অসহায়ত্বের কথাও তুলে ধরেছিলেন ঢাকায় মালয়েশিয় হাইকমিশনার হাযনাহ মো. হাশিম। 
‘মালয়েশিয়ার ৪৭ নিয়োগদাতার লাইসেন্স স্থগিত’ খবরটি সত্য নয় : জনশক্তি খাতে হয়রানি: ‘মালয়েশিয়ার ৪৭ নিয়োগদাতার লাইসেন্স স্থগিত’ শিরোনামের খবরটি গত বছরের হলেও শুক্রবারের খবর বলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সদ্য চালিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কয়েকটি নিউজ পোর্টালেও একই সময়ে এই খবর প্রকাশ করে। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটি গত বছরের হলেও শুক্রবার বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ও নিউজ পোর্টালের এমন প্রকাশিত খবরে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে পাঠক এবং ভিউয়ারদের। 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS