সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করে লেখক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘আমি ফেসবুকের খুব বিরোধী। ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করা আমার চোখে অপছন্দের কাজ। কারণ একটাই মাত্র জীবন। এটাকে তো নষ্ট করা যাবে না। আমি যদি বসে বসে একটা স্ক্রিনে তাকিয়ে দুনিয়া দেখি, সেটা কিছু হলো কি না? দুনিয়া কত সুন্দর, সেটা নিজের চোখ দিয়ে দেখব না কি শুধু স্ক্রিনে যতটুকু দেখাবে সেটা দেখব?’
মঙ্গলবার (১১ জুন) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত ‘চ্যালেঞ্জড শিক্ষার্থী সম্মেলনে’ তিনি এসব কথা বলেন। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা দুই শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান।
সম্মেলনে মহামারি করোনাভাইরাসের সময়ে শিশুদের হাতে ভার্চুয়াল ক্লাসের নামে মোবাইল ফোন তুলে দিয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘করোনাকালে কী সর্বনাশ যে হয়েছে, সেটা খুব ভালো করে জানি। এখন সবাই বলছেন সর্বনাশ! বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন দেওয়া যাবে না। অথচ করোনাকালে সবার হাতে একটা স্মার্টফোন তুলে দিয়েছি আমরা। সে স্মার্টফোন আর হাত থেকে নামেনি। এখনো আছে তাদের হাতে। সেটা দিয়ে কাজের কাজ কী হচ্ছে, সেটা আমি জানি না। এটা দিয়ে আমরা সর্বনাশ করেছি।’
ফেল শিক্ষার্থীদের দোষে হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা ফেল করেছে তাদের কোনো দোষ নেই। অথচ তাদের পেছনে একটা সিল দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এরা পাস করতে পারেনি। আমি শিক্ষক, অনেক বই লেখার সঙ্গে আমি জড়িত। আমাদের দেশের লেখাপড়ার সমস্যাটা কী, তা খুবই ভালো করে জানি।’
শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা মন খারাপ করো না। আমাদের দেশের পড়াশোনার সিস্টেমটা ভালো না। এটা খুবই ভালো করে আমি জানি। কেউ যখন সাকসেসফুল বা সাফল্যের কথা বলে, সেটা আসলে সে পরীক্ষাটা ভালো দিয়েছে। আর কিচ্ছু না। কেউ পরীক্ষাটা ভালো দেয়, কেউ খারাপ দেয়। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। সেটার অনেক কারণ তো আমরা খুঁজেও দেখি না।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এ অধ্যাপক বলেন, ‘এবার আমাদের দেশে তিন লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেখানে তিন লাখ মানুষও নেই। তিন লাখ শিশুকে বলা হয়েছে, তোমরা পরীক্ষায় পাস করোনি। আমরা চাই, এ তিন লাখ শিশু যেন আবার পরীক্ষা দেয় এবং উত্তীর্ণ হয়।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমি লিখে দিতে পারি, তোমরা যদি আবার পরীক্ষা দাও, তোমরা সবাই উত্তীর্ণ হবে। কারণ পাস না করার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেশে ফেল করতে হলে কষ্ট করতে হয়। পরীক্ষায় ফেল করাটা এত সহজ নয়। তোমরা যারা ফেল করেছো, নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ ঘটে গেছে। কারণ না ঘটলে তোমরা ফেল করবে না।’
তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। শিক্ষার্থীদের বলতাম- ক্লাসে আমরা যেটুকু তোমাদের শেখাই, সেটা হলো পাঁচ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ তোমাদের আশপাশ দেখে জীবনের জন্য শিখতে হবে। তাহলে তুমি সত্যিকারের শিক্ষার্থী হবে। তোমরা ফেল করেছো মানে ওই ৫ শতাংশে আটকা পড়েছ। বাকি ৯৫ শতাংশে তোমরা আটকা পড়নি।’
সম্মেলনে সকালের অধিবেশনে অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম নাহিদ, সাবেক সচিব এন আই খান, সংস্কৃতিজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। এ ছাড়াও বক্তব্য শেষে বাঁশি বাজিয়ে এবং সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।
বিকেলে দ্বিতীয় ও শেষ অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সংসদ সদস্য এম এ মান্নান ও আরমা দত্ত। বক্তব্য শেষে শিক্ষার্থীদের এভারেস্ট বিজয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প শোনান এভারেস্ট বিজয়ী এম এ মুহিত এবং অনুপ্রেরণাদায়ক সংগীত পরিবেশন করেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী নকীব খান ও ফাহমিদা নবী। সম্মেলনে দেশের ৪২টি জেলা থেকে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।