পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিতে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীতে বাড়ছে পানি। ইতোমধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। তলিয়ে গেছে অনেক অঞ্চলের নদী তীরবর্তী এলাকা। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক অবস্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যায় এই দুই জেলার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই ধেয়ে আসা তৃতীয় দফার বন্যার কারণে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
ইতোমধ্যে এই দুই জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জে অনেক অভ্যন্তরীণ সড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষ। নতুন করে দেখা দিয়েছে ভাঙন আতঙ্ক। পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও মধ্যাঞ্চল শেরপুরের বিভিন্ন নদীতেও পানি বাড়ছে। অন্যদিকে পার্বত্য জেলাগুলোর কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। আজ ভোরে খাগড়াছড়ির আলুটিলার সাপমারায় পাহাড় ধসে ঢাকা-খাগড়াছড়ি ও ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় সিলেটে জীবনযাত্রা পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলেও অনেক উপজেলা থেকে পানি নেমে গেছে। নদনদীর ১০ পয়েন্টের মধ্যে কেবল কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্ট ছাড়া অন্যগুলোতে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে যায়। কিন্তু গত রোববার (৩০ জুন) রাত থেকে পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে বিভাগের বিভিন্ন নদনদীর পাশাপাশি নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। বিশেষ করে গতকাল সকাল থেকে সুরমার কানাইঘাট পয়েন্টেও পানি আবার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করেছে।
এছাড়াও সুরমার সিলেট পয়েন্টে, কুশিয়ারার অমলশীদ, শেওলা ও শেরপুর এবং লোভা, সারি, ডাউকি ও গোয়াইনসারি নদীর পয়েন্টে বিপৎসীমার কাছাকাছি পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
সোমবার (১ জুলাই) এক দিনেই সিলেটের বিভিন্ন নদীর ১০ পয়েন্টের মধ্যে চারটির পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সুরমা নদীর গোলাপগঞ্জ এলাকা, জৈন্তাপুরের বড়গাঁঙ নদী, পিয়ান ও সারি নদীর বিভিন্ন এলাকায় পানি বেড়ে লোকালয়ে ঢুকতে দেখা গেছে। দু’দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
সিলেট ছাড়াও সুনামগঞ্জ জেলার নদনদীতেও পানি বাড়ছে। দুই জেলার নদী ছাড়াও আবার পানি বাড়ছে গ্রামীণ এলাকায়। সকালে অনেক গ্রামীণ রাস্তা আবার তলিয়ে গেছে, পানি উঠছে বাড়িঘরে। এতে আবার বন্যার মুখে পড়েছেন এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় আবারও বাড়তে শুরু করেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি। এরই মধ্যে নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করে অনেক এলাকা পুরোপুরি ডুবে গেছে। সোমবার (১ জুলাই) সকালে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করে বলে জানিয়েছে সিলেট পাউবো। আবার পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি যাদুকাটা নদী হয়ে তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের আনোয়ারপুরের একটি অংশ প্লাবিত করেছে। পানি বৃদ্ধির এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ফলে খেয়া নৌকা ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানিয়েছেন, বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে। পানি বাড়তে থাকলে আবারও বন্যা হবে। গতকাল সোমবার সিলেটে ১৭৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, উজানের ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের অনেক নিচু সড়ক প্লাবিত হয়েছে। এতে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরে দেখা দিয়েছে বন্যা। তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের আনোয়ারপুর-বালিজুড়ি রাস্তা, শক্তিয়ারখলা ১০০ মিটার রাস্তা ও লালপুর সড়কটি এখন ৩ ফুট পানির নিচে। এ রাস্তায় চলাচলকারী লোকজন নৌকা কিংবা বিকল্প যানবাহনে চলাচল করছেন।
শুরু সিলেট সুনামগঞ্জেই নয়, দেশের উত্তরাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কিছু কিছু এলাকায় বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করবে আগামী বুধবার থেকে। সব মিলিয়ে সামনের এক সপ্তাহ দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী তীরবর্তী মানুষের ভোগান্তির শেষ থাকবে না।
ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুরে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল কাউনিয়ার তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
দু’দিনের বৃষ্টি এবং উজানের ঢলে গাইবান্ধার প্রধান চার নদনদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। সেখানকার তিস্তার পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তবে ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টানা বৃষ্টিতে নেত্রকোনার প্রধান নদী উব্ধাখালী নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া সোমেশ্বরী ও কংশের পানিও বেড়ে চলেছে।
ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুসারে শনিবার (২৯ জুন) সকাল থেকে সোমবার (১ জুলাই) সকাল পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পর্বত এলাকায় ৮০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের উজানে ভারতীয় এলাকায় হওয়া বৃষ্টির পুরো পানিটাই নেত্রকোনা, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার নদীগুলো দিয়ে নিচে নেমে আসবে। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঝারি থেকে ভারী এবং আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এ সময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। একইসঙ্গে আগামী ৭২ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, পুরাতন-সুরমা, সারিগোয়াইন নদীর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার কতিপয় নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। অপরদিকে বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তায় আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।