ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে পালালো আনসাররা : আহত ৩৫, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে উদ্ধার হলেন অবরুদ্ধ উপদেষ্টা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা অফিস : রাতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল সরকারের পরিচালনার প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। ১০ ঘন্টা সচিবালয়ে আনসার সদস্যরা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েক উপদেষ্টা এবং সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
এদের উদ্ধারে গেলে ছাত্র-জনতার সাথে ব্যাপক সংর্ঘষ হয় আনসার সদস্যদের। তবে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায় আনসার সদস্যরা। টানা ১০ ঘণ্টা সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ রাখার পর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ছত্রভঙ্গ হয় তারা।
গতকাল রোববার রাতে সচিবালয়ে এ ঘটনা ঘটে। রাত ৯টার পর সংর্ঘষ শুরু হয়। এ ঘটনায় ৩৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলেও জানা গেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথমদিকে দুই পক্ষ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হলেও এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে সকাল ১১টা থেকে সচিবালয়ের সবগুলো গেট বন্ধ করে সচিবালয়কে কার্যত অকার্যকর রাখা হয়।
আনসার সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তাদের ফেলে যাওয়া পোশাকে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপর তারা সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে আনসার বিলুপ্তর দাবি জানান। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আসে।
সংর্ঘষে ৩৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এর আগে আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে সচিবালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ করেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, সবাই রাজু ভাস্করে আসেন। স্বৈরাচারীশক্তি আনসার হয়ে ফিরে আসতে চাচ্ছে। দাবি মানার পরও আমাদের সবাইকে সচিবালয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
এছাড়াও ফেসবুক কমেন্টে জানান, ‘এসব করাচ্ছে এনামুল
হক শামীম, শরিয়তপুর আসনের সাবেক এমপি। তার বড় ভাই এই আনসারের ডিজি ছিলেন। এবং এই সব আনসার তার ভাইয়ের রিক্রুটেড।’ এরপরই ছাত্র-জনতা সচিবালয়ে আসেন। তারা অবরুদ্ধ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমকে উদ্ধার করতে গেলে আন্দোলনরত আনসারদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এর আগে বিভিন্ন দাবি নিয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় বসা আনসার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা জানান, আমাদের দাবি পূরণের আশ্বাস ও দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করছি। কিন্তু তারপরও আনসার সদস্যরা অবরুদ্ধ করে রাখেন সচিবালয়। আর তাতেই সৃষ্ট হয় সংকট।
বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, আমরা তিন উপদেষ্টা এবং অন্যান্য সহকর্মী সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এখন থেকে আনসারে কোনো ‘রেস্ট প্রথা’ থাকবে না। একই সঙ্গে অন্যান্য দাবি-দাওয়াগুলো নিয়ে একটি কমিটি করা হবে। এই কমিটি সবকিছু পর্যালোচনা করে আমাদের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নেব।
আনসারে ‘রেস্ট প্রথা’ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতি তিন বছর চাকরির পর আনসার সদস্যদের ছয় মাস রেস্টে থাকা লাগে। এই ছয় মাস পর তারা আবার জয়েন করেন। এই ছয় মাস তাদের খুব মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। নিয়োগ বিধিমালা থেকে এই প্রথা বাতিল করে কীভাবে তাদের চাকরিতে রেগুলার করা যায়, সে প্রক্রিয়ায় কাজ করা হচ্ছে। সাধারণ আনসারদের মধ্যে চারজন প্রতিনিধি নিয়ে আগামী সাত দিনের মধ্যে তারা একটি সুপারিশ দেবেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, তথ্য, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, যুব, ক্রীড়া, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া।
এ সময় তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, যেহেতু একটি কমিটি হয়েছে, সেহেতু বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের একটি জাতীয় সংকট চলছে। আমাদের অনেকদিকে কাজ করা লাগছে। এই দুর্যোগকালীন সময়েও এই সুপারিশ কমিটি সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। আনসার ভাইদের যে সমস্যা, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে একটি যৌক্তিক সমাধানে আমরা পৌঁছাব।
এদিকে রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, সচিবালয়কে ঘিরে কোনো আন্দোলন করতে দেওয়া হবে না। ছাত্রদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের খুঁজে বের করা হবে।
টানা ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা : চাকরি জাতীয়করণের এক দাবি নিয়ে আনসার সদস্যদের আন্দোলনে টানা ১০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ হয়ে ছিলেন প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অনেকেই তখন ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েন। বের হওয়ার জন্য এ গেট থেকে ওই গেটে ছুটলেও, বের হতে পারেননি তারা। রাত ৯টায় সচিবালয়ে বিভিন্ন গেট ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, হাজার-হাজার আনসার সদস্য গতকাল সকাল থেকে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে।
একপর্যায়ে দুপুর ১২টা থেকে তারা সচিবালয়কে অবরুদ্ধ করে রাখে। এরপর দুপুর একটার দিকে আন্দোলনের একাংশ সচিবালয়ের তিন নম্বর গেট দিয়ে সেনাবাহিনীর বাঁধা উপেক্ষা করে ভেতরে প্রবেশ করে স্লোগান দেন। কিছুক্ষণ পর তাদের জোর করে বের করে দেওয়া হয়। এরপর সব গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিকেল ৫ টায় অফিস ছুটি হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বের হতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আনসার প্রতিনিধিদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে, তার কিছুক্ষণ পরেই আবারও আন্দোলন শুরু করেন আনসার সদস্যরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তারা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।