ভিডিও

প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছাচ্ছে না ত্রাণ

নৌকা-ট্রলার দেখলেই পানি ডিঙিয়ে আসেন বানভাসীরা, বন্যায় মৃত্যু বেড়ে ২৭ এখনও বিকল ৯১১ মোবাইল টাওয়ার

প্রকাশিত: আগস্ট ২৭, ২০২৪, ১১:৩৮ রাত
আপডেট: আগস্ট ২৮, ২০২৪, ০১:২৭ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

করতোয়া ডেস্ক : টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে সৃষ্ট বন্যার কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো ঠিকঠাকমত সবাই ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। প্রধান সড়কের আশপাশে সহযোগিতা পেলেও প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে পৌঁছাছে না ত্রাণ সহায়তা। সেখানে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি ক্ষুধার্ত অধিকাংশ শিশু। ফলে অধিকাংশ জায়গায় দেখা দিয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার।

এদিকে দেশে চলমান বন্যায় ১১ জেলায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২৭ জন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন মানুষ। আজ মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম এসব তথ্য জানান।

ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১১টিই আছে। ১১ জেলায় মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৩৭৫ জন। পানিবন্দি পরিবার ১২ লাখ ৭ হাজার ৪২৯টি। ৭৪ উপজেলা বন্যা প্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন/পৌরসভা ৫৪১টি।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বন্যায় মোট ২৭ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ১০ জন, ফেনীতে একজন, চট্টগ্রামে ৫ জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৫ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া একজন, লক্ষ্মীপুরে একজন এবং কক্সবাজারে তিনজন মারা গেছেন।

এখনও বিকল ৯১১ মোবাইল টাওয়ার : বন্যার পানিতে মোবাইল অপারেটর কোম্পানির টাওয়ারের গ্রিনফিল্ড ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ডুবে যাওয়ার কারণে তৈরি হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক জটিলতার। পরবর্তী সময়ে কিছু এলাকায় নেটওয়ার্ক পুনঃস্থাপন করা সম্ভব হলেও     


পানি না কমায় ১১টি জেলায় নেটওয়ার্ক পুনঃস্থাপন কার্যক্রম করা যাচ্ছে না। ফলে এখনও ৯১১টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে। আজ মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) সকালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) অস্থায়ী পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

গতকাল সোমবার (২৬ আগস্ট) দিবাগত রাত ১১টা পর্যন্ত হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ ব্যাহত হওয়া ১১টি জেলা হচ্ছে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও কক্সবাজার।

এরমধ্যে নোয়াখালী জেলায় ২৬৩টি, লক্ষ্মীপুর জেলায় ৫৯টি, ফেনী জেলায় ৪৬৩টি, কুমিল্লা জেলায় ৬৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৩টি, চট্টগ্রাম জেলায় ১৯টি, খাগড়াছড়ি জেলায় ২০টি, হবিগঞ্জ জেলায় ৩টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৫টি, সিলেট জেলায় ৮টি ও কক্সবাজার জেলায় ৫টি মোট ৯১১টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে। এর বিপরীতে এই ১১টি জেলার মোট টাওয়ার রয়েছে ১৪ হাজার ৫৫১টি। যার মধ্যে এখন সচল রয়েছে ১৩ হাজার ৬৪০টি।

নোয়াখালীতে প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছায়নি সহায়তা, মানুষের হাহাকার : জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। ১ হাজার ১৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন দুই লাখ ১৬ হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ৮৮২ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে আটটিতেই বন্যার পানি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সদর, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বন্যার পানি। এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোয় সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণই এখন পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ফলে বন্যার্ত মানুষ সীমাহীন কষ্টে দিন যাপন করছেন।

বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জয় কৃষ্ণরামপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয় নিয়েছেন বিধবা হোসনে আরা। তিনি বলেন, এখানে থাকার মতো, ঘুমাইবার মতো অবস্থা নেই। আল্লাহ আমাদের এভাবে রাখছে। একটা কাপড় একটা জামা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আইসি। আমার সামর্থ্য নাই ঘরবাড়ি করার। ছেলেরাও গরিব। কিচ্ছু করতে পারবে না তারা।

ত্রাণের নৌকা-ট্রলার দেখলেই পানি ডিঙিয়ে আসেন তারা : ভয়াবহ বন্যার কবলে কুমিল্লার ১৪টি উপজেলার লাখ লাখ মানুষ। বানের পানিতে সর্বহারা এসব মানুষের ভরসা এখন সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ। পানিতে সবগুলো সড়কে বুকপানি।

ফলে সেসব এলাকায় ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোট। সেখানে ত্রাণ দেওয়ার জন্য কেউ গেলেই বুক পানি ডিঙিয়ে সেখানে হুড়মুড়িয়ে ছোটেন নারী-পুরুষ সবাই। গোমতীর বাঁধ ভাঙনকবলিত বুড়িচং উপজেলার খাঁড়াতাইয়া গ্রামে গেলে দেখা যায়, একটি দ্বিতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অর্ধশতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিংবা ট্রলারের শব্দ শুনেই একটু খাবার ও পানির আশায় ছুটে আসেন তারা।

এ গ্রামের সব বাড়িতেই পানি। কেউ কেউ গেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ গোমতী বাঁধে। কেউবা আবার গ্রামের উঁচু ভবনে। তবে পুরুষদের কেউ কেউ পানিবন্দি হয়েই বাড়িতেই থেকেছেন মালপত্র রক্ষায়। খাঁড়াতাইয়া গ্রামের চারদিকে থই থই পানি। কোথাও একটু মাটি দেখা যায়নি। এত পানি, এত সংকটের মাঝেও পানিবন্দি অনেকেই বাড়িতে থেকে গেছেন। নৌকার শব্দে ছুটে আসেন রফিকুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা।

তিনি বলেন, ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সব পানিতে তলিয়ে গেছে। ত্রাণের নৌকা থেকে খাবারের সঙ্গে চেয়ে নেন মশার কয়েল, দুই বোতল দুধ ও খাবার পানি। তিনি জানালেন, শুকনো খাবার যা পাচ্ছেন, তা দিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। খাবার পানির অনেক সমস্যা। কয়েকদিন হলো রান্না করা খাবার পাইনি।

ওই গ্রামের একটি দ্বিতল ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন অর্ধশতাধিক বানভাসি। আফজাল হোসেন নামে একজন জানান, তিন সন্তান নিয়ে সেখানে আছেন তিনি। তাদের আরও ত্রাণ ও পানি দরকার। ভবনে আশ্রয় নেওয়া লোকদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার নেই।

লক্ষ্মীপুরে ত্রাণ পৌঁছছে না দুর্গম এলাকায় : ‘সবাই রাস্তার আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামে যারা আছে, তাদের কাছাকাছি ত্রাণ পৌঁছায় না। দুর্গম হওয়ায় কোমর পানি মাড়িয়ে কেউ ভেতের যেতে চায় না। ’লক্ষ্মীপুরের বন্যা কবলিত দুর্গম মান্দারীর মোহাম্মদ নগর ও যাদৈয়া এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা এভাবে আপেক্ষ করে কথাগুলো বলেন।

যাদৈয়া গ্রামের কিশোর রিফাত, শুভ, রূপক বলেন, ‘মহাসড়কের পাশে বসে থাকি। অনেকগুলো গাড়ি ত্রাণ নিয়ে এসেছে। ত্রাণ নিয়ে আসা স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা রাস্তার আশপাশের বাড়িতে ঢুকে ত্রাণ দিয়ে যান। তাদের আমরা বলেছি, আমরা সহযোগিতা করব, একটু ভেতরে চলুন। সেদিকের অবস্থা খুব খারাপ। পানি বেশি, চরম কষ্টে আছে লোকজন। কিন্তু ভেতরে বুক পরিমাণ পানিতে নামার ভয়ে তারা সেদিকে যাননি।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া এবং মোহাম্মদ নগর গ্রাম দুটি মহাসড়ক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে। মহাসড়ক দিয়ে ওই এলাকার দিকে যেতে আঞ্চলিক যে সড়কটি ব্যবহৃত হয়, সেটি পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও বুক পানি। পানি মাড়িয়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ৩০-৪০ মিনিট। কিন্তু এতো দুর্ভোগ সহ্য করে ও সময় নিয়ে কোনো স্বেচ্ছাসেবী ওই এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যেতে চাননি।

ফলে গত চার-পাঁচদিন ওই দুই গ্রামের কয়েক হাজার পানিবন্দি মানুষ ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি আশ্রয়কেন্দ্র দুটিতে। তবে সোমবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দেওয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকার তিনশ পরিবারকে। এছাড়া একটি সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও কিছু খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে। সোমবারই প্রথম ত্রাণের দেখা পেয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। যদিও তা চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল ছিল?

ফেনীতে খাবার সংকট চরমে : ফেনী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া বাড়ি-ঘর ও এলাকাগুলোতে পানি কিছুটা কমেছে। তবে যে ক্ষত তা থেকে উঠা এখনো সম্ভব হয়নি। এলাকাগুলোতে এখনো ঘরে ফেরার উপক্রম হয়নি। নতুন করে মুছাপুরে ক্লোজার ভেঙে যাওয়ায় চর এলাকার বাড়ি-ঘর ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে বেড়েছে ভিড়।

আজ মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) দাগনভূঞা উপজেলার দাগনভূঞা বাজার, বেকের বাজার, সিলোনিয়া বাজার, ফাজিলের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়- বড় মার্কেট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, কলেজ ও বহুতল ভবনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া প্লাবিত এলাকার বহুতল ভবনেও আশ্রয় নিয়েছে এলাকার বাসিন্দারা। ব্যবস্থা হয়েছে হেলথ কেম্পেরও।

দেখা গেছে, এখানে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও বিত্তশালীরা এগিয়ে এসেছে মানুষের উপকারে। বিভিন্ন জন থেকে অর্থ ও খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে খাবার ব্যবস্থা করছে আশ্রয় নেওয়া মানুষের জন্য। ভলেন্টিয়াররা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। খাবার প্যাকেজিং করছে। কেউ ট্রাকে করে নৌকা করে পৌঁছে দিচ্ছে। আবার বিভিন্ন জায়গায় চুলা বসিয়ে আয়োজন করা হয়েছে রান্না-বান্নার। দাগনভূঞা বাজারে উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া এখানকার বিভিন্ন বহুতল বাড়িগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে অনেক মানুষ। তাদের তিনবেলা খাবার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখানকার প্রতিনিধিদের।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS