এমএ বাসেত, তেঁতুলিয়া (পঞ্চগড়) : পঞ্চগড়ের বড় ৬টি নদীসহ ৩৯টি নদীতে সঠিক পানি প্রবাহ নেই। প্রাকৃতিক জীব বৈচিত্র চরম হুমকির মুখে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পঞ্চগড় সূত্রে জানা যায়, জেলায় আন্ত:সীমান্ত বড় নদী ৬টি এবং অভ্যন্তরীণ ছোট নদী ৩৩ টিসহ মোট ৩৯টি নদী রয়েছে।
বড় নদীগুলো হলো- মহানন্দা, করতোয়া, চাওয়াই, পাথরাজ, ঘোড়ামারা ও তালমা। এসব নদীগুলোর উৎস প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন থেকে। এসব বড় নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলো শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়।
এখন নদীগুলোর বুকে কোথাও ধূধূ বালুচর আবার কোথাও সবুজ ফসলের মাঠ। নদীগুলোতে পানি প্রবাহ না থাকায় নানা প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি এখন বিলুপ্তির পথে। পঞ্চগড় সদরের সাথে তেঁতুলিয়া উপজেলার সীমানা ভাগ করেছে চাওয়াই নদী। বড় ও ছোট নদীগুলো ভারত থেকে প্রবাহিত হয়ে পঞ্চগড় জেলার বুক চিরে ভাটির দিকে বয়ে গেছে।
মহানন্দা নদী নেপালের হিমালয় পর্বত ও ভারতের সিকিম রাজ্যেও সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে বাংলাবান্ধা ঝাড়ুয়াপাড়া নামকস্থানে ভারত-বাংলাদেশ ভূখন্ডকে আলাদা করেছে। মহানন্দা ঝাড়ুয়াপাড়া থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে।
এছাড়া ভারত থেকে প্রবাহিত ডাহুক, করতোয়া, চাওয়াই, তালমা, পাথরাজ, ঘোড়ামারা নদী পঞ্চগড় শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তজার্তিক সংযুক্ত নদী কমিশন চুক্তি (ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও চীন) শর্তাবলী লঙ্ঘন করে বড় নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ করায় ভাটির দিকে নদীগুলোতে পানি প্রবাহ শুকিয়ে বালুচর জেগে উঠেছে।
এলাকার চাষিরা এসব স্থানে বোরো-ইরি ধানসহ রবিশস্য চাষাবাদ করায় বর্তমানে নদীর বুকে ভরা জলরাশির বদলে সবুজ ফসলের মাঠ দৃশ্যপট পরিলক্ষিত হচ্ছে। নদ-নদীগুলোতে বর্ষা/শুষ্ক মৌসুমে সাধারণ পানি প্রবাহ না থাকায় নদীর চারপাশের প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে।
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৩৮টি উজানে ড্যাম, ব্যারেজ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করেছে। একইভাবে ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে মহানন্দা নদীর উজানে শিলিগুড়ি (ভারত) ফুলবাড়ি নামকস্থানে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করেন।
ফলে বাংলাবান্ধা থেকে তেঁতুলিয়া সদরের পুরাতন বাজার পর্যন্ত সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর বুকে ধূধূ বালুর চর জেগে উঠেছে। এছাড়া ডাহুক নদীর উজানে ভারত রায়গঞ্জ নামকস্থানে স্লুইচ গেট নির্মাণ করায় নদীটি মরে গেছে।
অনুরুপভাবে ভারতের রায়গঞ্জ মদনবাড়ী ও ভদ্রেশ্বর সাও নদী ও করতোয়া নদীর মিলনস্থলের উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ ঘুরিয়ে নেওয়ায় করতোয়া নদীর বুকে বালুচর জেগেছে। একইভাবে চাওয়াই নদীর উজানে স্লুইচ গেট নির্মাণের কারণে নদীতে পানি প্রবাহ নেই।
এসব নদীগুলোতে পানি প্রবাহ না থাকায় দেশিয় নানা প্রজাতির মাছ, জোঁক, ব্যাঙ ছোট বড় জলজ প্রাণিগুলো বিলীন হয়েছে। নদীতে প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহ না থাকায় আশপাশের ফসলি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘূর্ণিঝড়, প্রচন্ড খরা, নতুন পোকামাকড় ও রোগ বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।
পাশাপাশি গাছপালা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এদিকে বর্ষা মৌসূমে ভারত মাঝেমধ্যে সবগুলো নদ-নদীর স্লুইচ গেট খুলে দেয়ায় নদীর ভাটির অঞ্চলে ফসলের ক্ষতিসহ বাড়িঘর বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।
পঞ্চগড় পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে চাওয়াই নদীর পানি প্রবাহের জন্য বালু খনন করে। খননকৃত বালু ভেকু মেশিন দিয়ে নদীর দু’ধারে উঁচু বাঁধের ন্যায় ফেলে রাখে। কিন্তু বিগত বর্ষা মৌসুমে খনন করা বালু নদীতে পড়ে পুনরায় ভরে গেছে।
তখন এই নদী খনন কাজের অনিয়ম-দুনীর্তি নিয়ে জেলার পরিবেশবাদী সুশিল সমাজ ও কয়েক জনপ্রতিনিধি রীতিমত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদের পাশাপাশি পঞ্চগড় শহরে মানববন্ধন করেছিলেন। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থ বছরে তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট নদী প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করে। এই নদীর খনন কাজের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও এলাকার সুশিল সমাজ নানা প্রশ্ন তুলেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক ও উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি মো. জিয়াউর রহমান বলেন, আন্তজার্তিক নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ করায় ভাটির অঞ্চলে নদীর পানি প্রবাহ নেই। অনেক বড় বড় নদী অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করায় নদীর সঠিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।
ফলে অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং নদীর আশপাশে জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র হুমকির হাত থেকে রক্ষার জন্য নদীর গতিপথ সচল রাখতে সরকারকে প্রতিবেশি দেশের সাথে আলোচনা করে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।