ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ১২ মিনিটের ভারী বৃষ্টি ও তুমুল ঝড়ে দুটি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এ সময় ঝড়ের কবলে পড়ে দুই নারী ও জমে থাকা পানিতে ডুবে আড়াই বছরের এক শিশু মারা গেছে। শনিবার (১ জুন) ভোর ৫টার দিকে উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়ন ও বড়বাড়ী ইউনিয়নের ওপর দিয়ে এই ঝড় বয়ে যায়।
মৃতরা হলেন—পাড়িয়া ইউনিয়নের শালডাঙ্গা গ্রামের পইনুল ইসলামের স্ত্রী ফরিদা বেগম (৪০), একই গ্রামের দবিরুল ইসলামের স্ত্রী জাহেদা বেগম (৫০) এবং একই উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের লালাপুর নয়াপাড়া গ্রামের নাজমুল ইসলামের ছেলে নাঈয়ুম।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভোরের দিকে ঝড়ের তাণ্ডবে পাড়িয়া ইউনিয়নের তিলকড়া, শালডাঙ্গা, বঙ্গভিটা, লোহাড়া, বামুনিয়াসহ ১২টি গ্রাম এবং বড়বাড়ী ইউনিয়নের বেলহাড়া, বেলবাড়ী, বটের হাট, হরিপুরসহ আটটি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির টিনের চাল উড়ে গেছে। গাছ ভেঙে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। এতে পাঁচ লক্ষাধিক টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মৃত ফরিদা বেগমের স্বামী পইনুল ইসলাম বলেন, ‘সকালে ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে থাকা অবস্থায় ঝড় শুরু হয়। বাড়িতে এসে স্ত্রীকে খুঁজে না পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করি। পরে বাতাসে উড়ে এসে বারান্দায় পড়ে থাকা টিন ও ছাউনি সরিয়ে দেখি নিচে চাপা পড়ে আছে। তাকে উদ্ধার করে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।’
পাড়িয়া ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশের দফাদার আজিজুর রহমান জানান, ঝড়ের সময় বারান্দায় বসে ছিলেন দবিরুল ইসলামের স্ত্রী জাহেদা। মেঘের গর্জন আর ঝড়ে গাছপালা ভেঙে পড়তে দেখে বারান্দাতেই মারা যান তিনি।
দবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ঝড়ের সময় ভয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে ধারণা করছি।’
লালাপুর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়ির পাশে গর্তে বৃষ্টির পানি জমে ছিল। খেলতে গিয়ে আমার ছেলে নাঈয়ুম পড়ে যায়। পরে পরিবারের লোকজনের নজরে এলে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড়বাড়ী ইউনিয়নের আধারদিঘী বাজারে পাঁচটি দোকান এবং দুটি হোটেলের ওপর গাছ ভেঙে পড়েছে। ঘরের টিন নষ্টসহ সার ও কীটনাশক ব্যবসায়ী এবং সিমেন্টের ব্যবসায়ীর পাঁচ লাখের বেশি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিক ও কলেজের প্রভাষক মশিউর রহমান বলেন, ‘ঝড়ে লোহাগাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের হলরুমের টিনের চাল উড়ে মাঠে এসে পড়েছে। বিদ্যালয়টির প্রবেশদ্বারে বৈদ্যুতিক খুঁটির ওপর গাছ ভেঙে পড়েছে। এছাড়া লোহাগাড়া থেকে বঙ্গভিটা যাওয়ার রাস্তা এবং বড়বাড়ি ইউনিয়নের আধারদিঘী থেকে হরিণমারী যাওয়ার রাস্তায় একাধিক গাছ ভেঙে রাস্তায় পড়ে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।’
পাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী রুবেল বলেন, ‘ভোরবেলায় মানুষজন যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন ঝড়ে আমার ইউপির অন্তত ১২ গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। ঘটনার পর এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গাছপালা রাস্তায় পড়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।’
আধারদিঘী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘আধারদিঘী বাজারে শতবর্ষী কিছু আমগাছ ছিল। ঝড়ে সেগুলোর ডাল ভেঙে পড়েছে দোকানগুলোর টিনের ছাউনির ওপর। এতে দোকানগুলোর ক্ষতি হয়েছে।’
ঝড়ে ৪০টির বেশি বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে এবং ভেঙে গেছে বলে জানালেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বালিয়াডাঙ্গী জোনাল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এছাড়া অনেক স্থানে বৈদ্যুতিক তারের ওপর গাছ ভেঙে পড়েছে। বিকালের দিকে বালিয়াডাঙ্গী বাজারে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়েছে। বাকি সব এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ। সকাল থেকে আমাদের লোকজন মাঠে কাজ করছেন।’
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফছানা কাওছার বলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান এবং আমাদের লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণে কাজ করছেন।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন সোহেল বলেন, ‘ঝড়ে মরিচ, বোরো ধান, পটলসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিসংখ্যান সংগ্রহে মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।’
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম সুজন ঝড়ে তিন জনের মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। এলাকাগুলো পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।