মোঃ কায়ছার আলী
“আছে বন্যা প্লাবন খরা, আছে দু:খ কষ্ট জরা। তার পরেও এইদেশ আমাদের প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা।” বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন, দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সূর্যাস্ত সূর্যোদয়ের লীলাভূমি কুয়াকাটা এবং হাজার নদ নদীর বর্ষায় পলি দিয়ে গড়া নদীমাতৃক দেশ আমাদের প্রিয় জন্ম জন্মান্তরের শেষ ঠিকানা বাংলাদেশ। হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য থাকলেও এর অভ্যুদয়ে রয়েছে এক আনন্দ বেদনার মহাকাব্য।
যেখানে মিলেমিশে আছে হৃদয় মথিত শোক এবং প্রতিরোধের দৃঢ়চিত্ত উত্থান, জীবন উৎসর্গ করে জীবন জয় করার আখ্যান। নিজস্ব মহিমা চেতনা বুকে ধারণ লালন করে অপরাজেয় বাঙালি জাতি। ষড়ঋতুর এই দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে আমাদের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়। বর্ষার জলধারার প্রায় ৯২% চীন ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসে।
তখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি প্রবাহের কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাব ফেলে এবং মানুষের জীবন যাত্রায় প্রচন্ড নেতিবাচক হয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। প্রায় ৮০% পানি অন্যত্র চলে যাওয়ায় পানির অপচয় ঘটে। এই পানি কিভাবে ধরে রাখা যায় বা প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ গবেষণা চলছে।
মানবসভ্যতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে পরিবেশ, যা মূলত মানবসভ্যতারই বিবর্তনের ফসল। নতুন শতাব্দীতে নানা কারণে অ কারণে এর মহাবিপর্যয়ের সংকেত ধ্বনিত হচ্ছে। আমাদের অতি বৃষ্টি, বন্যা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব ইদানিং বেড়ে গেছে। তাই তো সেদিন খবরে দেখলাম মাদারীপুরে এক বিশাল স্কুল ভবন চিরতরে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার দৃশ্য।
আর সাথে সাথে মনটা তছনছ হয়ে গেল এবং মনে পড়ল হৈমন্তি শুকলার অমর গান “আমার বলার কিছু ছিল না,,,চেয়ে চেয়ে দেখলাম,,,।” এভাবে চলতে থাকলে শেষ পরিণতি ভয়াবহ হবে। প্রতিবছর পঞ্চাশ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবার পাঁচ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। কিভাবে মাটির ক্ষয়রোধ করা যায় তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা চলছে। কিছু পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে আজ লিখতে বসলাম।
আসলে রিপোর্ট হল তথ্যের নির্মোহ গাঁথুনি, যাতে থাকে না, অনাহুত মন্তব্য, অপ্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ, অযাচিত পক্ষপাতিত্ব এতে শুধুই থাকে সোজাসাপ্টা বর্ণনা। সে কারণে এটি হয়তো সুখপাঠ্য ঠিক নয়। কিন্তু দেশ বা জাতির জন্য খুবই উপকারী। বিশ্বকবির ১৪০০ সাল কবিতা “আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি কৌতুহল ভরে..........আজি হতে শতবর্ষ পরে” পড়লে মনে যায় তিনি তেরশত সালে বসে চৌদ্দশত সালের কবিতা বা ভাবনা লিখেছেন।
বিদ্রোহী কবি ১৯৪২ সালে অসুস্থ হওয়ার আগেই সংকল্প কবিতায় লিখেন “বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে..........”। আসলেই তাঁরা কালজয়ী শতবছর পরের কথা বা বাস্তবতা লিখে গেছেন। একজন মানুষ শতবছর সাধারণত বাঁচে না বা ক্ষমতায় থাকে না। কিন্তু শতবছরের পরিকল্পনা করতে দোষ কি? রাষ্ট্রনায়কেরা তা করে থাকেন।
বর্তমান সরকারের রাষ্ট্রনায়ক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৪ ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সভায় বন্যা, নদী ভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার জন্য অন্তত শত বছরকে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল হিসাবে “বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০” অনুমোদন করেছেন।
এর অধীনে আপাতত ২০৩০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য অন্তত ৮০টি প্রকল্প গ্রহণ করবে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শতবর্ষী এ পরিকল্পনা নেয় সরকার। এতে দুনিয়ার সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে আরেক বন্ধুপ্রতীম বদ্বীপ দেশ নেদারল্যান্ড।
নেদারল্যান্ড এর রয়েছে নদীব্যবস্থাপনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। তারা সবকিছু সঠিকভাবে পরিকল্পনা মাফিক বাস্তবায়ন করে চলেছে। ইংরেজি শব্দ ডেল্টা অর্থ বদ্বীপ। বদ্বীপ শব্দটি গ্রিক ডেল্টা থেকে এসেছে। বাংলায় ব বর্ণের সাথে এর মিল থাকায় বদ্বীপ নামটি প্রচলিত হয়।
বদ্বীপ প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ত্রিকোণাকার ভূমি যা নদীর মোহনায় (সমুদ্র নিকটবর্তী অঞ্চল) ভেসে আসা পলি মাটি দিয়ে সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলে সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৪ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কিভাবে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণ করে দীর্ঘমেয়াদী করা যায় তা এই মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত আছে।
২১০০ সালে বাংলাদেশকে কোন জায়গায় দেখতে চাই তা বদ্বীপ পরিকল্পনায় বলা আছে। পৃথিবীতে এত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আর কোন দেশে আছে কি না তা আমার অতি ক্ষুদ্রজ্ঞানে জানা নেই। বঙ্গীয় বা গাঙ্গেয় বদ্বীপে তথা আমাদের জন্মভূমিতে ডেল্টা প্ল্যান টেকসই উন্নয়ন ভাবনা শতভাগ ধাপে ধাপে পরিকল্পনা মত কার্যকর হোক।
হয়তো আমরা সেদিন (২১০০ সালে) কেউ বেঁচে থাকব না, তবে আমাদের পরের প্রজন্ম থাকবে। তারা সফলতা পাবে, এ বিশাল মহৎ কর্মের জন্য।
লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
01717-977634
kaisardinajpur@yahoo.com
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।