ভিডিও

ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি"

ফারুক আহম্মেদ জীবন 

প্রকাশিত: জুন ০৮, ২০২৪, ০৭:৫৬ বিকাল
আপডেট: জুন ০৮, ২০২৪, ০৭:৫৬ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ কলকাতার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের ঝাঁকড়া চুলের ভাসা ভাসা ডাগর চোখের দুখু মিয়া নামের আমি সেই দুঃখী ছেলেটির কথা বলছি। যে ছোট্ট থেকেই ছিল অতি চঞ্চল। ছিল অতি প্রখর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিজ্ঞান সম্পূর্ণ। অতিশয় দুরন্ত ও বলিষ্ঠ আর সুঠাম দেহের অধিকারী। তরতাজা সজীব প্রাণ উচ্ছ্বাস। শত দুঃখেও যার মুখ সদা হাস্যোজ্জ্বল থাকতো।
হ্যা, আমি বলছি বিংশশতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবির কথা। আমাদের অতি প্রিয় ঝাঁকড়া চুলের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথা। যিনি ছিলেন প্রেম বিরহের,প্রতিবাদী, দ্রোহের এবং সাম্য আর মৈত্রীর কবি।  এক মুসলিম পরিবারে
জন্ম নিয়েও মুসলমান ধর্মীয় শিক্ষা দীক্ষায় বেড়ে উঠলেও মানুষের মনে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে সকল মানবকে এক কাতারে দাঁড় করাতে গেয়েছেন সদা সাম্যবাদের জয়ের গান।
ইংরেজি ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের ২৪শে মে, বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ বাবা ফকির আহমেদ, আর মা জাহেদা খাতুনের কোল আলো করে গ্রাম্য এক জরাজীর্ণ কুঠিরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যার শৈশব, আর কৈশোর কেটেছে তুমুল ঝড়ঝাপটা আর নিদারুণ দুঃখ কষ্টের কঠিন বাস্তবতায়। যে বয়সে শিশুরা পড়ালেখা, ছবি আঁকা, আর তার সমবয়সী পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে খেলাধুলা হাসি আনন্দে কাটায় ঠিক সেই বয়সেই ছেলেটি মক্তবের গণ্ডিটা পেরুনোর আগেই বাবাকে হারিয়ে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে পথ চলেছেন। যার জীবনী নানাবিধ জটিল কঠিন বাঁধা বিপত্তির পটভূমিতে ঘেরা। সংগ্রামময়ী কঠিন এক রণাঙ্গনী জীবন। তবু থেমে থাকেননি। ঐটুকু বয়সে পিতাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে যে মক্তবে পড়াশোনা করেছেন সেই একই মক্তবেই আবার শিক্ষকতা করেছেন। আবার তার মহল্লার মসজিদে মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বাবার জায়গায় নিজে মাজারের খাদেমের কাজ করেছেন। কখনো চা, রুটির দোকানে রুটি বানিয়ে জীবন-জীবিকা জোগাড় করেছেন। এতো দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়েও জীবন রণাঙ্গনের হার না মানা যুদ্ধে তিনি পরাজয় স্বীকার করেননি। তারই মাঝে সে তার জীবনের লক্ষ্যে সর্বদা অটুট থেকেছে। রুটির দোকানে সারাদিন তিনি কঠিন পরিশ্রম করেও রাত জেগে নানান রকম বই পড়েছেন। বহু কবিতা ছড়া রচনা করেছেন।
কখনো বা- জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে কর্ম ছেড়ে আবারো স্কুলে ভর্তি হয়েছে সে বিদ্যা অর্জন করার জন্য। কিন্তু বারবার তাকে অভাব আর দরিদ্রতার কশাঘাতে পড়ে হোঁচট খেতে হয়েছে।  আবার তাকে স্কুল থেকে ফিরে আসতে হয়েছে পড়ালেখা বন্ধ করে। অভাব-অনটন আর টানাপোড়েনের সংসারের জন্য জীবন-জীবিকার খোঁজে আবার ছুটতে হয়েছে তাকে কর্ম স্থলে। তিনি কখনো কাজ নিয়েছেন তার চাচার সাথে গ্রাম্য লেটো গানের দলে। সেখানেও তিনি থেমে থাকেননি। কাজের ফাঁকে তিনি রচনা করেছেন নানান রকম নাটক, গল্প, ছড়া, কবিতা। সেখান থেকেও তিনি চলে এসেছেন আবারো জ্ঞান অর্জনের নেশায় স্কুলে শিক্ষকদের সাহচর্য পেতে। এভাবে কেটেছে তার শৈশব কৈশোর জীবন। 
একসময় যৌবনের শুরুতে তিনি উপার্জনের লক্ষ্যে ১৯১৭ খৃষ্টাব্দে মাত্র ১৮ বছর বয়সে যোগ দিয়েছে সেসময়কারের ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। পুরো আড়াইটি বছর কেটেছে তার সৈনিক জীবন। চাকরীতে থেকেও দুখু তার জীবনের স্বপ্ন থেকে একবিন্দু সরে আসেননি। কাজের মাঝে চালিয়ে গেছেন তার শৈল্পিক সাহিত্য কর্ম সাধনা। 
একসময় তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্য ৪৯ রেজিমেন্ট স্থগিত হয়ে গেলে। কবি সেখান থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। আর তখন তিনি কর্ম হিসেবে সাংবাদিক পেশাকে বেছে নেয়। সেই সঙ্গে চালিয়ে যান সাহিত্য কর্ম। একেরপর এক প্রকাশ হতে থাকে সেসময় ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার রচিত লেখাসমূহ। চারদিকে ছড়াতে থাকে তার নাম, যশ, খ্যাতি। 
কবি নজরুল প্রেমের পূজারী হলেও তার মাঝে লুকিয়ে ছিল সৌর্য্য-বীর্যে তেজে ভরা দামাচাপা স্ফুলিঙ্গের মত এক দ্রোহী আত্মা। আর তাইতো তিনি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীরদের অন্যায়,জুলুম অবিচার, অনাচার  শোষণ দেখে বিপ্লবী হয়ে ওঠেন।
প্রতিবাদের মশালের মত অগ্নিকুন্ডের বারুদ হয়ে  সব অপরাধকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করতে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠেন। লিখতে থাকেন শীতল রক্ত গরম করা বিদ্রোহী লেখা। কবির সে লেখা ব্রিটিশ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর মনে ভয়ানক ভীতি সৃষ্টি করে। কাঁপন ধরে তাদের পাপে ভরা মসনদে। কবি নজরে পড়ে যায় তখন ব্রিটিশ ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর। তখন কবিকে নজরদারিতে রাখতে থাকে তারা। একসময় তাকে রাজদ্রোহীতার অপরাধে বন্দী করে জেলে আটকে রাখে। তবু জেলখানার সেই  চারদেয়ালে বন্দী রেখেও কবির কলম এতটুকু থামাতে পারেনি। দিগুণ শক্তি হয়ে গর্জে উঠেছে। আমি বলছি আমাদের সেই প্রাণের কবি,ভালোবাসার কবি, সকল বাকহীন পরাধীন মানুষের স্বাধীনতা ফিরানো কবি, বাঙালীদের মুক্তির কবি, বেপরোয়া, একরোখা আর তেজস্বী ঝাঁকড়া চুলের সেই দুখু মিয়া নামের ছেলেটির কথা। যে আমাদের আদর্শ, আমাদের উদ্দীপনা আর অনুপ্রেরণার উৎস। যার সাতাত্তর বছর জীবনে অসুস্থ হওয়ার আগের চুয়াল্লিশ বছরের সুস্থ জীবনে মাত্র বাইশ তেইশ বছরে রচনা করেছেন অতুল সাহিত্য ভাণ্ডার। তিনি ছিলেন ছোট-বড় সবার কবি। যার অবদান শ্যামা সংগীত, নাত, হামদ্, নাটক, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ,ছড়া, কবিতা, গান, সাহিত্যের প্রতিটি শাখায়। তিনি ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী।  একাধারে কবি, একজন ভালো অভিনেতা ,গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, নাট্যকার, সাংবাদিক। কবি নজরুল নিষ্পেষিত জনতার হয়ে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বঞ্চিতের অধিকার ফিরাতে লড়েছেন বন্ধুর মতো পাশে থেকে। কবি নজরুল বিশ্বের সহস্র কোটি ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তুলেছেন তার বিদ্রোহী লেখনীর মধ্য দিয়ে। কবি নজরুল তাইতো জাগ্রত চেতনার এক নাম। অমর অক্ষয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক কালজয়ী নাম। প্রিয় কবি নজরুল তুমি ছিলে, তুমি আজো আছ। তুমি চিরদিন পুনরুজ্জীবিত হয়ে এভাবে বহমান রবে আমাদের মাঝে। তোমার যতো না সৃষ্টি দোঁলন চাঁপা, সঞ্চিতা, বিষের বাঁশি, সর্বহারা, বাঁধনহারা, ধুমকেতু, অগ্নিবীণা, বিদ্রোহীর মতো নানান রকম কালজয়ী লেখনীর মাঝে। 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS