ভিডিও

বন্যার্তদের কঠিন জীবন

সব নদীর পানি বিপদসীমার নিচে, মৃত বেড়ে ৩১ হাসপাতালে মোমের আলোয় ডেলিভারি : সাপের উপদ্রব

প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২৪, ১০:৫৩ রাত
আপডেট: আগস্ট ২৯, ২০২৪, ১০:৩৪ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

করতোয়া ডেস্ক : দেশের সব নদীর পানি এখন বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে নিজের ঘরবাড়িতে ফিরছে। তবে তাতে স্বস্তি মিলছে না। কঠিন লড়াই করে চলেছেন বানভাসী মানুষ। ত্রাণ সংকট রয়েছে। পৌঁছাচ্ছে না দুর্গম এলাকায়। এছাড়া এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি বিদ্যুৎ। ফলে অকেজো রয়েছে অনেক মোবাইল টাওয়ার।

ফলে এখনো শহরের প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না বন্যার্তরা। হাসপাতালে মোমের আলোয় প্রসূতিদের করানো হচ্ছে ডেলিভারি। এছাড়াও বন্যায় পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকায় বেড়েছে সাপের উপদ্রব। ফলে সব মিলে কঠিন সময়ই পার করছেন বানভাসীরা।

এদিকে, দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা। এছাড়া এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন।

মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবারের বন্যায়। গতকাল বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা জানান। তিনি আরও জানান, দেশে সাম্প্রাতিক বন্যায় ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

বন্যায় মৃতদের মধ্যে, কুমিল্লায় ১২ জন, ফেনীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৬, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও কক্সবাজারে ৩ জন। মৌলভীবাজারে দুই ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছেন। পানিবন্দি/ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৪ হাজার ৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং এসব কেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ জন লোক এবং ৩৯ হাজার ৫৩১টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল বুধবার জানিয়েছেন, শুধুমাত্র গোমতী নদীর কুমিল্লা পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। কিন্তু এখন সেটিও নেমে এসেছে। উজানে গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টি হয়নি। আর আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাসও নেই।

তাই আপাতত পানি বাড়ার সম্ভাবনা নাই আর,’ বলছিলেন তিনি। বর্তমানে গঙ্গা, পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আর বাংলাদেশের যমুনা ও কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত আছে। এছাড়া বাংলাদেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলো থেকেও পানি নেমে যাচ্ছে। সরদার উদয় রায়হান বলেন, আগামী দুই-তিন দিনের মাঝে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে পানির উচ্চতা ছিল ২০.৫৫ সেন্টিমিটার, এখনো তাই আছে। সাধারণত এই পয়েন্টের পানি যদি ২২.০৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে তখন সেটিকে বিপজ্জনক বিবেচনা করা হয় বলে জানান রায়হান।

লক্ষ্মীপুরে বন্যার অবনতি : লক্ষ্মীপুরে প্রতিদিন ঢুকছে উজানের পানি। তার সঙ্গে মঙ্গলবারে রাতভর বৃষ্টির পর জেলায় বন্যার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নৌকা সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্ধার কাজ। জেলায় দুর্গত মানুষের তুলনায় ত্রাণ কম বলে উঠেছে অভিযোগও। আরও অভিযোগ, রাস্তার পাশের এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছালেও একটু ভেতরের এলাকাগুলো তা যাচ্ছে না। জেলার সব কয়টি উপজেলার কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর আবার কোথাও গলা পর্যন্ত পানি। তলিয়ে রয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। 

রাস্তায় পানি ওঠায় সব উপজেলায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। এখনও ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই উঠছেন আশ্রয়কেন্দ্রে ও স্বজনদের বাড়িতে। কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, জেলায় পানির নিচে তলিয়ে আছে অন্তত ৩০ হাজার হেক্টর জমি। আর জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, পানিবন্দি সাড়ে আট লাখের বেশি মানুষ।

এদিকে পানিবন্দি এসব মানুষকে নিরাপদে আনতে নেই পর্যাপ্ত নৌকার ব্যবস্থা। যার কারণে দুর্গত মানুষ উদ্ধার করা যাচ্ছে না। উদ্ধার করতে গিয়ে ফিরে আসছে স্বেচ্ছাসেবীরা। আবার কেউ কেউ চোর-ডাকাতের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আসছেন না। আকস্মিকভাবে স্মরণকালের এই ভয়াবহ বন্যায় জেলা শহরসহ পাঁচ উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়ন ও চার পৌরসভার প্রত্যেকটি এলাকার মানুষ এখন পানিবন্দি।

অনেকের অভিযোগ, ১০ দিন পার হলেও ত্রাণ পায়নি। ত্রাণ নিয়ে অনেকেই রাস্তার পাশ দিয়ে গেলেও ভেতরে কেউ ঢুকছে না। তাই রাস্তা থেকে ভেতরের মানুষগুলো একটু বেশি কষ্টে আছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলায় ১৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। পানিবন্দি বানবাসী মানুষগুলোর বিশুদ্ধ পানি, খাবার, ওষুধ সঙ্কটে চারদিকে শুধু হাহাকার। এরই মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ।

ফেনী হাসপাতালে মোমের আলোয় ডেলিভারি  : গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টা। ফেনী জেনারেল হাসপাতালের পুরানো ভবনের দ্বিতীয় তলার প্রসব ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারে চলছে এক প্রসূতির প্রসবের প্রস্তুতি। মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন নার্স। আরেকজন নার্স রোগীর স্বাভাবিক প্রসবের কাজ করছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় মোমবাতির আলোতেই পৃথিবীর আলো দেখে পূজা রানী দাসের সন্তান।

শহরের সহদেবপুর এলাকার বাসিন্দা শিমুল চন্দ্র দাসের স্ত্রী পূজা রানী এমন এক সময় নবজাতকের মা হলেন-যখন স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী। জেলার চারদিকে কেবল থইথই পানি। বানের জলে ভাসছে ঘরবাড়ি। জীবন বাঁচাতে আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে মানুষ। প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেটবিহীন সময়টাতে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না অনেকেই।

এ পরিস্থিতিতে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গত সাত দিন ধরে মোমবাতি বা মোবাইল টর্চের আলোয় প্রসব ও সেলাইয়ের কাজ করা হচ্ছে, বললেন হাসপাতালের একজন নার্স। পূজা রানীকে জেনারেল ওয়ার্ডে স্থানান্তরের পর জানা গেল, স্বামী ও স্বজনরা প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জাম বাইরে থেকে কিনে এনেছিলেন। হাসপাতাল থেকে তারা কোনো ধরনের সহায়তা পাননি।

সাপেকাটা রোগীর হিড়িক : হাসপাতালে ২১ অগাস্ট থেকে সাপেকাটা রোগীর হিড়িক পড়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৪২ জন পুরুষ ও ১৩ জন নারী সাপেকাটার জন্য চিকিৎসা নিয়েছেন। দুপুরে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসেছেন সাপেকাটা রোগী শওকত আকবর। সদর উপজেলার লেমুয়া ইউনিয়নের মীরগঞ্জ গ্রামে তাকে সাপে কামড় দেয়। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে চিকিৎসা সেবা পান শওকত আকবর।

৭ দিনেও ত্রাণ পাননি নূর নাহার : নূর নাহার। সাতদিন ধরে পানিবন্দি। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর এবং ছেলে-মেয়ে মিলে ১৩ সদস্যের পরিবার। আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান সংকুলান না হওয়ায় রয়ে গেছেন নিজ বাড়িতেই। খাটের ওপর খাট দিয়ে রাত পার করছে এই পরিবার। রয়েছে খাবর সংকট। ৭ দিনেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা থেকে পাননি ত্রাণ সহায়তা। নিরুপায় হয়ে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গিয়েছেন মৈশাতুয়া বাজারে। সেখান থেকে কিছু শুকনো খাবর এবং রান্নার উপকরণ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। বুধবার কুমিল্লার মৈশাতুয়া ইউনিয়নের সামনে পানিতে তলিয়ে যাওয়া সড়কে দাঁড়িয়ে এ কষ্টের কথা বলেন নূর নাহার।

তিনি বলেন, ২১ আগস্ট থেকে বাড়ির উঠানে পানি উঠে যায়। পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে পানি। এক দিন পর ঘরে প্রবেশ করে বন্যার পানি। এরপর খাটের ওপর খাট দিয়ে থাকা শুরু করি। শুনেছি বাড়ির পাশে যে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে সেখানে থাকার মতো আর জায়গা নেই। তাই কষ্ট করে বাড়িতে রয়ে গেছি। তেলের একটি টিন কেটে কোনোরকম রান্না করছি। গত সাতদিন ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছে। যা আপনাকে বলে শেষ করা যাবে না।

সরেজমিন জানা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে কুমিল্লার বিভিন্ন উপজেলা, পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলা এবং বেশ কয়েকটি এলাকায় ডাকাতিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বাড়ছে পানির উচ্চতা। এতে মনোহরগঞ্জে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে বন্যা। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ। এদের উদ্ধারে উপজেলা জুড়ে কাজ করছে সরকারি বাহিনীসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা। অধিকাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি। এদের কাছে এখনো পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণ।

চালের ওপর দেলোয়ারের ‘দুরু দুরু’ চার দিন : ফেনীর সীমান্তবর্তী পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী নদীর পানি বেড়ে প্রায়ই বন্যা হয়, যার সঙ্গে বেঁচে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা এলাকাটির সাহসী মানুষই এবার বিপন্নতার মুখে পড়ার এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছেন। বন্যার পানি এতটাই দ্রুত সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় যে, মুহূর্তের মধ্যে প্লাবিত বিস্তৃর্ণ অঞ্চল দেখে ‘মৃত্যুভয়’ জেগে ওঠা জনপদটিতে জীবন বাঁচাতে অনেকে ‘কিংকর্তব্যবিমূড়’ হয়ে পড়েন।

নিজে বাঁচতে আর পরিবারের সদস্যদেরও রক্ষা করতে তাৎক্ষণিক যিনি যেভাবে পেরেছেন, কোথাও না কোথাও ঠাঁই করার চেষ্টা করেছেন। কেউ আশ্রয় নেন ঘরের চালে, কেউ ঘরের সিলিংয়ে, কেউবা তড়িঘড়ি উঠে পড়েন গাছে। এমন একজন হলেন পরশুরামের কাউতলি ইউনিয়ের কাশীনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. দেলোয়ার। তার সঙ্গে কথা হলে চারটা দিনরাত ঘরের টিনের চালের ওপর থাকার সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি।

কখন কী হয়, বন্যা আরও কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, চুরি-ডাকাতির আতঙ্ক- সব মিলে ভয়ে বুক দুরু দুরু অবস্থা ছিল তার, সেভাবে কাটে দিনগুলো। সেই গল্প শুনিয়েছেন দেলোয়ার। “চোখের পলকে হুড়ুহুড় করে সব কিছু ভেঙেচুরে ভাসিয়ে দিয়ে আসতে থাকে পানি। আর কখনও দেখিনি এমন বান,” বলেন তিনি।

কাশীনগর গ্রামে দেলোয়ার বানের তোড়ে ভয় পেয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে প্রাণ বাঁচতে উঠে পড়েন একটি বাড়ির টিনের চালার ওপর। তার প্রতিবেশীর বাড়িটি পাকা। বন্যা মোটামুটি স্থির হওয়ার পর দেলোয়ার তার স্ত্রী-সন্তানদের রেখে আসেন ওই পাকা বাড়ির ছাদে। নিজের ঘরের মায়ায় তিনি থেকে যান টিনের চালের ওপর।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS