ভিডিও

শিক্ষাকে বিস্তৃত করতে হলে জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে হবে : সলিমুল্লাহ খান

প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ০৯:২১ রাত
আপডেট: আগস্ট ৩১, ২০২৪, ০৯:২১ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

শিক্ষাকে বিস্তৃত করতে হলে জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে হবে বলে জানিয়েছেন দেশের প্রথিতযশা চিন্তাবিদ ও বিশ্লেষক সলিমুল্লাহ খান। তিনি বলেছেন, ‘এই কোটা আন্দোলনের মূল কথা ছিল মেধার ভিত্তিতে জাতীয় সার্ভিসে লোক নিতে হবে। এখন মেধার মধ্যে কোন বৈষম্য আছে কিনা সেটা যাচাই করতে হবে। মেধাকে প্রাধান্য দিলে দেশে এত ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন? স্বাধীনতার পরে দেশে একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষার আকাঙ্ক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা নিশ্চিত করা হয়নি। আমাদের শিক্ষাকে বিস্তৃত করতে হলে, জনগণের মধ্যে যদি শিক্ষাকে গভীর করতে হয় তাহলে জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে হবে।’

 

শনিবার (৩১ আগস্ট) বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ:  শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এই পর্যালোচনা সভার আয়োজন করেছে অভ্যুত্থান পর্যালোচনা ফ্লাটফর্ম ‘জুলাই গণপরিসর’।

সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘মেধাকে বৈষম্যহীন করতে পারলে সংখ্যাবিজ্ঞানের নিয়মে আমরা অনেক ভালো মানুষ পাব। কিন্তু এখনও বহু মানুষ বঞ্চিত। সবাই সেই সুযোগে অংশগ্রহণ করতে পারে নাই।’

 

তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা সারা বিশ্বে একই রকম। সারা পৃথিবীতে এইচএসসি বা সমমান পর্যন্ত বুনিয়াদি শিক্ষা। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ বলছে, এটা হতে হবে সার্বজনীন। আর প্রাথমিক শিক্ষাকে আবশ্যিক করা হয়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশে ৬ষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক। কিন্তু আমাদের দেশে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। এরপর পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা। সেটা সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে।’

পেশাগত শিক্ষা আবশ্যক করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের হিসাব অনুসারে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষা হচ্ছে পেশাগত শিক্ষা। এই পেশাগত শিক্ষা আবশ্যক করা যাবে না। এটা বিনামূল্যেও করা যাবেনা। তবে যে কেউ এই শিক্ষা নিতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া যাবেনা। আসন নেই অযুহাতে ভর্তির সুযোগ দিচ্ছি না এটা জাতিসংঘের লক্ষ্যের বিরোধী। যারা যা পড়তে চায় আমরা তা পড়তে দিচ্ছি না। আমাদের চাহিদা অনুসারে পড়বেন না নিজের মনের বাসনা অনুসারে পড়বেন সেটা হচ্ছে আমাদের পলিসির প্রশ্ন। এই সমস্যার সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে। এটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্য।’

কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সমাজকে তৈরি করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ যখন ইঞ্জিনিয়ার হয় সে তার পরিবারের ইঞ্জিনিয়ার হয় না, সে হয় সমাজের ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের সমাজে সবচেয়ে সাবসিটি পাওয়া প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বুয়েট। কিন্তু বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদেশ চলে যায়। আমাদের দেশের কৃষক তার কষ্টার্জিত টাকা থেকে যে সাবসিটি দেয় তা থেকে আমরা সুবিধা পাচ্ছি না। সুবিধা পাচ্ছে মার্কিন দেশ। এটা আমাদের পরিকল্পনার ত্রুটি।’

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে সংস্কার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘১৮৫৪ সালে ইংরেজি আমলে একটি শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছিল। তখন ইংরেজ সরকার একটা নিয়ম তৈরি করেছিল বেসরকারি উদ্যোগে আপনি স্কুল তৈরি করবেন ইংরেজ সরকার সেখানে ১০ শতাংশ ভর্তুকি দিতো। এখনও সে ঐতিহ্য চলমান। কোন দেশের ৯৭ ভাগ মাধ্যমিক বেসরকারি উদ্যোগে চলে। শিক্ষকদের বেতন অনিয়মিত, কোনো স্কেল নেই। চাকরির কোন গ্যারান্টি নেই। সেই অবস্থায় কেমন করে ভালো মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করবেন। এই নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। শিক্ষার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করতে না পারলে শিক্ষার সংস্কার সম্ভব নয়। এই শর্তগুলোর মধ্যে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কমিশন করতে হবে। সব চাহিদা পূরণ করতে হবে।’

এই বিশ্লেষক বলেন, ‘জাতিসংঘ ও এনজিওদের চাপাচাপিতে প্রাথমিকে মেয়ে ও ছেলে শিশুদের অংশগ্রহণ প্রায় সমান সমান হয়েছে এটা আনন্দের বটে। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে ২৫ শতাংশ শিশু ড্রপ আউট হয়ে যায়। এটা নিয়ে কথা বললে কেউ শুনতে চায় না।’

নবম শ্রেণীতে বিভাগ ভাগ করে দেওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমারা ৯ম শ্রেণিতে এসে বিভাগ ভাগ করে দেই। এটা মার্কিন দেশের কৌশল। তাদের লক্ষ্য ছিল আমাদের তথাকতিথ উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্য একটা ক্ষুদ্র এলিট তৈরি করা। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী কী তার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে? এই বয়সে কোন শিক্ষার্থী তার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে পারেনা। দ্বাদশ শ্রেণীর আগে পর্যন্ত গ্রুপ ভাগ করা ঠিক নয়। শিশু কোন ধরনের স্কুলে পড়বে তা নির্ধারণ করবে তার মা-বাবা।’

২০২৪ সালের গণবিপ্লবের পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে সলিমুল্লাহ খান বলেন, ‘অনেকে এবারের বিপ্লবের পর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনকে নাকচ করে দিচ্ছেন। আবার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগকে অস্বীকার করেছিলেন। এগুলো ভুল। আমাদের স্বাধীনতা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। আর এখনকার বিপ্লব স্বাধীনতার সমান। এই তিনটি আমাদের ইতিহাসের বড় মোড় পরিবর্তন। কোনোটাকেই নাকচ করা যাবেনা।’

আলোচনা সভার ধারনাপত্র পাঠ করেন শিশু ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের (শিশির) আহ্বায়ক রাখার রাহা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অতীতের মতো আবারও এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক কাজটা অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে সম্পন্ন করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে সমাজের সর্বস্তরে যে আলাপ চলছে সেখানে শিক্ষা একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসাবে বিরাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার আজ অতি মুমূর্ষু দশা। একটা স্বাভাবিক সুস্থ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য যে ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, মুমূর্ষুর জন্য তা নেওয়া যায় না। মুমূর্ষুকে বাঁচাতে প্রথমেই যেমন দ্রুত তার সমস্যা শনাক্ত করতে হয়, তেমনি দ্রুততার সঙ্গে তাকে সঠিক দাওয়াইটাও দিতে পারতে হয়। সুতরাং এ দুটো কতটা সঠিক ও দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব হচ্ছে, তার উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের শিক্ষার ঘুরে দাঁড়ানো অথবা মৃত্যুর দিকে আরও এগিয়ে যাওয়া। তাই শিক্ষা নিয়ে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর বা দলের বা সংগঠনের যে ভাবনাই থাক, বা সামষ্টিকভাবে যে উদ্যোগই গ্রহণ করা হোক, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমে এই দিকটি ভাবতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘যেকোনো খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের জন্য অন্তত ৪টা ধাপে ভাবতে হয় জরুরি, স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী। খাতের চরিত্র এবং পতনের দশা বুঝে কোন কাজটা কোন ধাপে করা হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা, চিহ্নিত কাজ বা পদক্ষেপগুলোর আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয় করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সক্ষমতার সঙ্গেই সেই খাতের পতিত দশা থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। সুতরাং বাংলাদেশের শিক্ষাকে এই পতিত দশা থেকে উদ্ধার করতে হলে সবাইকে উদ্ধার তৎপরতার এসব ধাপ ও তাদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে হবে এবং তার ভিত্তিতে কথা বলতে হবে।’

সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘শিক্ষাকে নানা ভাগ করার মাধ্যমে আমাদের হয়তো ইচ্ছে করেই বিভাজিত করে রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রের স্থপতিরা চান সবাইকে এক রাখতে। কিন্তু স্বাধীনতার পর কৌশলে নানাভাবে ট্যাগ লাগিয়ে আমাদের বিভাজিত করে রাখা হয়েছে। মেধায় এগিয়ে থাকলে কাউকে ট্যাগিং দেওয়া উচিত নয়।’

অভ্যুত্থান পরবর্তীতে বৈষম্যহীন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলে, ‘শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। শিক্ষা কখনও ওয়ার্ড ব্যাংক, আইএমএফ বা কোনো প্রজেক্ট দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া যেতে পারেনা। এসব প্রজেক্ট আমাদের একদিকে প্রভাবিত করে। শিক্ষাকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তা করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয়কে খুশি করার জন্য ক্লাস ওয়ান থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আইসিটি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তি হয় না।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন জাতীয় সমস্যা উল্লেখ করে অধ্যাপক কামরুল বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায় ৮ শতাধিক কলেজে এইচএসসি থেকে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়। এটা বিশ্বের কোনো দেশে নেই। কারণ অনার্স পড়ানোর জন্য অন্তত পিএইচডিধারী শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশের অনার্স কলেজগুলো কোনো ভালো শিক্ষক নেই, ক্লাস হয়না। শুধু পরীক্ষা ফিস নেয় আর পরীক্ষা নেয়। এই ফিস নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আনন্দ ফুর্তি করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখন জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়লের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘বিশ্বের সব সূচকেই বাংলাদেশের শিক্ষার অবস্থান অনেক পিছিয়ে। আমরা কিভাবে এই সূচকে এগিয়ে যাব তা নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়েছে। এটা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।’

লেখক ও আলেম মনযূরুল আলম বলেন, ‘আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলি। কিন্তু বিজ্ঞানের মধ্যে ধর্ম ডেকে আনি। তাহলে বৈষম্য দূর হবে কিভাবে। বৈষম্য দূর করতে হলে পারস্পারিক আস্থা আনতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, স্কুল শিক্ষার্থী এসব ভাগ না করে সবাইকে শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সার্টিফিকেট বাতিল করে যোগ্যতার মাধ্যমে বিবেচনা করতে হবে।’

এক্সেল একাডেমির অধ্যক্ষ জিনাত আফসানা বলেন, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পরে দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার চালুর দিকে ছিল মন ছিল। তবে তখন বাংলায় ভালো বই না থাকায় আমরা অনেক পিছিয়ে যাই। তবে আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতে ইংরেজি চালু থাকায় তারা এগিয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যম নিয়ে আমাদের দেশে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। বর্তমান দেশের অনেকের ধারণা ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়েন তারা দেশ সম্পর্কে ভালো জানে না। এটা ভুল ধারনা। আমরা ইংরেজির সঙ্গে বাংলা সাহিত্যও পড়াই। এখন আমরা একটা গ্লোবাল ভিলেজে কাজ করছি। এখানে ইংরেজি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সব মাধ্যমের শিক্ষায় ইংরেজিকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।’

আলেম ও লেখক মুসা আল হাফিজ বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে অনেক গালগল্প শুনেছি। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছর শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন গল্প শুনেছি। কার থেকে কে ভালো গল্প বলে তা দেখেছি। মূলত এই সময় অবস্তুগত উন্নয়নকে পেছনে পেলে বস্তুগত দৃশ্যমান উন্নয়নকে সামনে আনা হয়েছে। এটা হয়না, এতে দেশ পেছনেই থেকে যায়।’



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS