ভিডিও

বগুড়ায় রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে সাধুসহ ৫ জন নিহত, আহত ৪০

প্রকাশিত: জুলাই ০৭, ২০২৪, ০৭:০৩ বিকাল
আপডেট: জুলাই ০৮, ২০২৪, ০৪:২২ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

স্টাফ রিপোর্টার : বগুড়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রায় বিদ্যুৎতায়িত হয়ে ৫ জন নিহত এবং অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আজ রোববার (৭ জুলাই) বিকেল  ৫টার ১০ মিনিটে বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান এই ৫ জন।

নিহতরা হলেন- শহরের পুরান বগুড়া এলাকার লঙ্কেশরের স্ত্রী অতশী (৪৫), দুপচাঁচিয়ার কুন্দগ্রামের লবাণু বৈরাগীর ছেলে নরেশ মোহন্ত (৫৮), অলোক কুমার (৩৮), রঞ্জিতা ও সারিয়াকান্দির সাহাপাড়া এলাকার জলি রাণী সাহা (৩২)। নিহত অলোক কুমার ইসকন মন্দিরের একজন সাধু।

যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটে : ইসকন মন্দির কমিটির সভাপতি দিলীপ কুমার দেব জানান, প্রতি বছর শহরের সেউজগাড়ী পালপাড়ায় ইসকন মন্দির কমিটির উদ্যোগে রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও রথযাত্রার আয়োজন করা হয়।

রথযাত্রা উপলক্ষে আজ রোববার (৭ জুলাই) সকাল থেকেই সেউজগাড়ী পালপাড়ায় ইসকন মন্দিরে  বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার ভক্ত জমায়েত হতে থাকেন। বিকেল নাগাদ মন্দির প্রাঙ্গণ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। রথযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য সমবেত হন কয়েক হাজার ভক্ত।

এরপর মন্দির থেকে ৩শ’ গজ দূরে সেউজগাড়ী পালপাড়ায় দুর্গা পূজামন্ডপের সামনে স্টেশন রোডে রথযাত্রার উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি বগুড়া সদর (৬) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো: সাইফুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার (পদোন্নতি প্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী।

উদ্বোধনের পর হাজার হাজার ভক্ত শিশু-কিশোর, নারী, পুরুষ রশি টেনে রথ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। রথের গন্তব্য ছিল সেউজগাড়ী থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বনানীতে পুলিশ লাইন্স সংলগ্ন শিব মন্দির। ১২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট চওড়া লোহার তৈরি জগন্নাথের এই রথটি। এই রথে লোহার চূড়া ছিল আরও ২০ ফুট। যা ছিল সোনালি রঙ করা।

রথটির সামনের অংশ দেখতে মিনি ট্রাকের মত। এতে স্টিয়ারিং আছে এবং কাঠ ও লোহা দিয়ে তৈরি চাকা। রথের হাইড্রেলিক ব্রেকও আছে। গোবিন্দ চন্দ্র সেন নামে একজন চালক রথটির স্টিয়ারিং দিয়ে রথের নিয়ন্ত্রণ করেন। ইসকন মন্দিরের অধ্যক্ষ খরাজিতা কৃষ্ণদাস ব্রহ্মচারি রথে বসে রথটি পরিচালনা করছিলেন। হাজার হাজার ভক্ত সেউজগাড়ী দুর্গা মন্দিরের সামনে থেকে টেনে টেনে রথটি নিয়ে যাওয়া শুরু করেন।

রথের মধ্যে ছিল শতাধিক ভক্ত। সেখান থেকে দেড়শ’ গজ দূরে রথটি যখন আমতলা তিন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। ২০ ফুট লম্বা রথের লোহার চূড়ার সাথে সড়কের ওপর দিয়ে যাওয়া উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শ লাগে। এতে আগুন ধরে যায়। আগুনে ঝলসে  যায় শিশু  ও নারীসহ ৩০ জন।

এরপর তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে  নেয়া হলে মারা যান মোট ৫ জন। এর মধ্যে আতোশি রাণী (৪৫), নরেশ মোহন্ত (৩৬), অলোক কুমার (৩৮) ও রঞ্জিতা (৩০) এবং বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে মারা যান জলি রাণী সাহা (৩২)।

গুরুতর আহত হন শহরের সেউজগাড়ী পালপাড়ার রঞ্জন পাল, শিবু পাল, সুবাস রায়, আক্কাস, গেবিন্দ, স্বপন সরকার, বিপ্লবসহ মোট ৪০ জন। হাসপাতালে আহাজারি: সেউজগাড়িতে রথযাত্রায় বিদ্যুতায়িত হয়ে আহতদের শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আহত ও নিহতদের আত্মীয় স্বজন আহাজারি করতে থাকেন।

ডাক্তার আহতদের কাউকে মৃত ঘোষণা করার সাথে সাথে কান্নার রোল পড়ে যায়। তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আহতদের সাহায্যের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ সব বয়সী মানুষ এগিয়ে আসে। আহতদের নিয়ে হাসপাতালে প্রবেশের সাথে সাথে ছোটাছুটি শুরু হয় সহযোগীদের। কেউ ট্রলি এগিয়ে নিয়ে আসে কেউ কাঁধে করে তুলে নিয়ে জরুরি বিভাগে নেয়। কেউ বা ছুটে যায় ওষুধ স্যালাইন কিনতে।

ঘটনার পর পরই এ্যাম্বুলেন্স, রিকশা, সিএনজিচালিত অটেরিকশায় করে আহত ও নিহতদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রতিটি রোগীর সাথে তিন থেকে ৪ জন করে সহযোগী থাকায় জরুরি বিভাগ লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জরুরি বিভাগে এমন হৈচৈ হয় যে, কেউ কারো কথা বুঝতে পারে না। জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আহতদের বেডে পাঠানোর সময় এক সঙ্গে অনেক ট্রলি না পাওয়ায় অনেককে কাঁধে করে তৃতীয় তলায় নিতে হয়েছে।

এলাকায় শোকের ছায়া : বগুড়ায় রথযাত্রায় দুর্ঘটনায় সেউজগাড়ি ও এর আশপাশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে নয় সকলের মধ্যে শোক ছড়িয়ে পড়ে। এমন ঘটনায় হতবিহবল বগুড়াবাসী। এ শোক সেউজগাড়ি ছাপিয়ে সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ে।

ঘটনার পর পরই সাধারণ মানুষ উদ্ধার কাজের জন্য ওই এলাকায় ছুটে যায়। তারা আহতদের টেনে তুলে নিরাপদ স্থানে নেয়। সব ধর্মের মানুষ, বন্ধুবান্ধব দুর্ঘটনার খবর শোনা মাত্রই পাশে দাঁড়ায়। শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্রই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রথযাত্রার ঘটনা। এ ঘটনায় সেউজগাড়ির হিন্দু মুসলমান সকলের বাড়িতে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।

শজিমেক এ এমপি রিপু : বগুড়ায় রথযাত্রায় মর্মান্তিকভাবে নিহত ও আহতদের দেখতে শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতল এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে গিয়েছিলেন বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপু। তিনি নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং আহতদের সুচিকিৎসা করানোর আশ্বাস দেন। শজিমেক হাসপাতাল থেকে বের হয়ে তিনি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে যান। সেখানে আহতদের সাথে কথা বলে খোঁজ খবর নেন।

এদিকে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু এঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

জেলা প্রশাসকের ঘোষণা : সেউজগাড়িতে রথযাত্রায় মর্মান্তিক ঘটনার পর বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম নিহতদের সৎকারের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে এবং আহতদের সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

তিনি প্রতিবেদককে জানান, আহত অবস্থায় যারা হাসপাতালে রয়েছেন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদেরকে সর্বোচ্চ সহায়তা দেওয়া হবে। তিনি নিহত ও আহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপার : বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী রথযাত্রায় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পর পরই আহতদের সহায়তায় শজিমেক হাসপাতালে ছুটে যান। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। চিকিৎসা বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে তিনি কিছুক্ষণ আহতদের সাথে অপারেশন থিয়েটারে অবস্থান করেন।

বগুড়া পৌরসভার সহায়তা : বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা ও প্যানেল মেয়র পরিমল চন্দ্র দাস গতকালের ঘটনার পর পরই শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে তারা আহতদের চিকিৎসায় সহায়তা করেন।

তাৎক্ষণিকভাবে আহতদের জন্য ওষুধ কিনে দেন পরিমল চন্দ্র দাস। পরিমল চন্দ্র দাস জানান, পৌরসভার পক্ষ থেকে নিহতদের লাশ বাড়ি পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়। পোস্টমটেম ছাড়াই লাশ গ্রহণ করে স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। আহতদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে।

বগুড়া সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শুভাশীষ পোদ্দার লিটন মর্মান্তিক ঘটনার পর পরই শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। তিনি সেখানে আহত ব্যক্তিদের খোঁজ খবর নেন এবং তাদের পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলেন।

এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহন।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS