ভিডিও

মজুদ বিরোধী অভিযান

আব্দুল হাই রঞ্জু

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪, ০৫:৪৮ বিকাল
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪, ০৫:৪৮ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বিপদ যেন আমাদের পিছু ছাড়তেই চায় না। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবল আবারও বাড়তে পারে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারেরও ধারণা ছিল, উন্নত দেশগুলো করোনার কবলে যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিল, সেভাবে হয়ত আমাদের সংকটে পড়তে হবে না। অবশ্য চীনসহ ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলো অনেক আগেই আক্রান্ত হলেও বাংলাদেশে শুরু হয়েছে খানিকটা পড়েই।

দেখতে দেখতে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যু দু’টোয় বেড়ে প্রায় শূন্যের কোঠায় আসলেও আবারও আতংক ছড়াচ্ছে। এর মাঝেই আমফানের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই আছে। আবার এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টানা মাসাধিক কাল ধরে শৈত্য প্রবাহের কবলে দেশের মানুষের নাকাল অবস্থা। এমনকি শৈত্য প্রবাহের কারণে ফসলেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এতসব প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও বোরোর চাষাবাদও চলছে। এ বছর চারার সংকট তেমন ছিল না। ফলে লক্ষ্যমাত্রার জমিতে চারা রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। যদি আর কোন দৈব দশায় চাষীদের পড়তে না হয়, তাহলে আশা করা যায়, বোরোর ফলনও ভাল হবে। আর সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে তো এ বছর বোরোর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধানের উৎপাদন হবে।

তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, চালের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে কেন? বাস্তবে এই হিসাবটা মেলাও কঠিন। কারণ কাগজ-কলমের হিসাবে তো, গরমিল হতেও পারে। অবশ্য মাঝে মধ্যে সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ মন্তব্যও করেন, তথ্য-উপাত্তগুলো ঠিক ঠাক মতো প্রকাশিত হচ্ছে কি না, তাও ক্ষতিয়ে দেখা উচিৎ। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘কাজির গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই’। খাদ্যশস্য উৎপাদনে যদি এই প্রবাদের মিল থাকে, তাহলে তথ্য বিভ্রাটের কারণেও ভোক্তার কষ্ট বাড়তে পারে।

আমাদের বৃহৎজনগোষ্ঠীর দেশ। যে দেশের সিংহভাগ ভোক্তাকেই চাল কিনে ভাত খেতে হয়। আর বাঙালির প্রধান খাদ্যই হচ্ছে ভাত। কথায় আছে, ‘ডাল ভাত হলেই যথেষ্ট’। সেই ভাতের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে সরকারও বদ্ধ পরিকর। এরপরও অনেক সময় তথ্য বিভ্রাট, অবৈধ মজুদ, সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে খাদ্য শস্যের দাম বেড়ে যায়, ফলশ্রুতিতে ভোক্তার কষ্ট বাড়ে।

অবশ্য বৈশ্বিক সংকটের বিরুপ প্রভাবে যেন খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সে লক্ষ্যে কৃষকদের নগদ অর্থ সহায়তা, সার-বীজ সরবারহসহ খাদ্য নিরাপত্তায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের কথা সব সময়ই প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেন, এটা ঠিক, বৈশ্বিক সংকট আমাদের অনেকটা পিছিয়ে দিচ্ছে। তারপরও কৃষির যে অবস্থা, তা যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বাস্তবতাও সে কথাই বলে।

আমাদের অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। কৃষিই আমাদের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন এনেছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি কৃষির কারিগড় কৃষকের ভাগ্যের যে পরিবর্তন হয়নি, সেটিও নিখাদ সত্য। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, সিডর, আইলা, আমফানের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকের কপালও পুড়ে। তার ওপর যদি কোন পণ্যের বাড়তি ফলন হয়, তাহলে ন্যায্যমূল্যের অভাবে কৃষকের কোমড়ও ভাঙ্গে। 
অবশ্য এ বছর ধান চাষীদের ধানের ন্যায্যমূল্য শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে।

গত বছর অতিবর্ষণ, উপর্যুপরি বন্যা হলেও হাওরের পাকা ধানসহ গোটা দেশেই কৃষক যথাসময়ে ধান কাটা মাড়াই করতে পেরেছে। আর গত বছর শুরুতে হাওরের কাচা ধান কৃষক সাতশত টাকা পর্যন্ত প্রতিমণে বিক্রিও করেছে। যা নিয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বেজায় খুশি ছিলেন। অবশ্য কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হলে খুশি হওয়াই স্বাভাবিক।

আর ধানের বাড়তি মূল্যের পরেও খাদ্য মন্ত্রণালয় ঘোষিত অভ্যন্তরীণ ধান, চাল সংগ্রহের গতিও ভাল ছিল। সরকার গত বোরো মৌসুমে দশ লাখ টনের ওপর চাল ও আট লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও গোটাদেশেই শতভাগ চাল কেনাকাটা হলেও ধান সংগ্রহ পুরোপুরি সফল হয়নি। অবশ্য ধানের মূল্য বৃদ্ধি, সংগৃহিত ধানের মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ না করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈশ্বিক মহামারীর কারণে অভ্যন্তরীণ ভাবে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও শেষ পর্যন্ত শতভাগ সফল হয়েছিল।

আর বাজার অর্থনীতির সুত্রই হচ্ছে, দাম বাড়লে সরবরাহ কমবে, আর সরবরাহ কমলে দাম বাড়বে। যেহেতু এ বছর শুরু থেকেই কৃষকের ধানের উপযুক্ত মুল্য নিশ্চিত হয়েছে, সেহেতু জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কৃষকের ধান তেমন বিক্রির আগ্রহও কম ছিল। ফলে গত বছর বোরোতে চাল কল মালিকগণ লোকসান দিয়ে হলেও চুক্তিকৃত চাল খাদ্য বিভাগকে পরিশোধ করেছিল।

আর খোলাবাজারে সে সময় একমন ধান এক হাজার টাকার ওপর কৃষক বিক্রি করেছিল। ফলে যে সময় সরকার ঘোষিত প্রতিমণ ধান এক হাজার চল্লিশ টাকায় সরকারি খাদ্য গুদামে বিক্রি করার তেমন কোন আগ্রহও কৃষকের ছিল না। যে কারণে সরকারের ধান সংগ্রহ শতভাগ সফলও হয়নি। সব মিলে সরকারের অভ্যন্তরীণ ধান চাল সংগ্রহ কর্মসূচি গত বছর পুরোপুরি সফল হলেও সংগ্রহ সেভাবে হয়নি।

আর এ বছর আমন মৌসুমেও চালের সংগ্রহ ভাল হলেও ধানের সংগ্রহ তেমন একটা হয়নি। আর এখন খোলাবাজারেই ধানের দাম বেশি। ফলে কৃষকও এ বছর ধান বিক্রি করে অনেকটাই লাভবান হয়েছে। অথচ বৃহৎজনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তায় যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের আপদকালিন খাদ্য মজুদ রাখাও বাঞ্চনীয়।

আর বর্তমানে সরকারের খাদ্য গুদামে মজুদের পরিমাণও সন্তোষজনক। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় দাবী করছে, এখন যে পরিমাণ খাদ্য শস্য সরকারি খাদ্য গুদামে মজুদ আছে, যা দিয়েই যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব। সে কারণে সরকার আতংকগ্রস্ত নয়। আমরাও চাই, জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা যেন কোনভাবেই বিঘ্নিত না হয়।

অবশ্য সরকার জনস্বার্থে যে কোন পণ্য যে কোন সময় আমদানি অথবা রফতানি করে থাকে। মূলত বৈশ্বিক সংকটের কারণে গোটা বিশ্বে যখন টলটলায়মান অবস্থার শুরু, তখন থেকেই বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলে আসছে, বৈশ্বিক সংকটের বিরূপ প্রভাবে গোটা বিশ্বেই খাদ্য সংকট হতে পারে। আর আমাদের দেশে তো এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সুযোগ সন্ধানীরা বসে থাকে না। এরওপর আবার ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো’ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ধান চালের বাজারও বেড়ে যায়।

যেহেতু এখন গোটাবিশ্বে মুক্ত বাজার অর্থনীতির ফমুর্লায় অধিকাংশ রাষ্ট্রই পরিচালিত হচ্ছে, সেহেতু পণ্য আমদানি কিংবা রফতানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সমস্যাও নেই। তাহলে বর্তমান খাদ্য শস্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না কেন? স্বাভাবিক উত্তর হচ্ছে, দেশে ধান চালের উৎপাদন ভালো, ফলে সরকার চাল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করছে। তবে সরকার এও ঘোষণা করেছে, প্রয়োজন হলে চাল আমদানি করা হবে।

এই যখন অবস্থা, সেই মুহূর্তে সরকারও চাল আমদানির উপর থেকে শুল্ক  প্রত্যাহার করতে দ্বিধাও করবে না। এমনতো না যে, সরকার আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করলে আর কোনদিন শুল্ক আরোপ করতে পারবে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল আসলে প্রয়োজনে উৎপাদকের স্বার্থে সরকার পুনরায় চাল আমদানির উপর শুল্ক আরোপ করতে পারবে।

দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা বিত্তশালীদের সুযোগ-সুবিধা দিতে স্বীয় স্বার্থেই জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত এলেও বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপন হয়। ফলে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়; আর গলাকাটা যায় ভোক্তার। এমনকি ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয় দেশের গুটিকতক মানুষ। সহজ-সরল এই সমিকরণটা ক্ষমতাসীনরা কি বুঝেন না? ঠিকই বুঝেন, কিন্তু পুঁজিবাদি রাষ্ট্র কাঠামোয় বিত্তশালীদেরকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়।

পাঠক মাত্রই লক্ষ্য করবেন, সম্প্রতি হঠাৎ চালের বাজার দর বেড়ে যায়। খাদ্যমন্ত্রী নিজে গোটা দেশেই অভিযান শুরু করেন। অভিযানে বেরিয়ে আসে অবৈধ মজুদের বাস্তব ঘটনা। এরপর দামে কিছুটা কমা শুরু হলেও আবার লুকোচুরির মতো চালের বাজারদর ওঠা নামা করতে থাকে। বলতে গেলে এখন বোরো চাষাবাদের ভরা মৌসুম চলছে।

লক্ষ্যমাত্রার পুরো জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। আশা করছি, এ বছর বোরোর ভাল ফলন হবে। আর বোরোর ফলন ভাল হলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তবে মজুদদার বিরোধী অভিযান অব্যাহতের পাশাপাশি চাল আমদানির বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত। যেমন আলু আমদানি শুরুর পর আলুর বাজার দর অনেকাংশেই কমে এসেছে। ঠিক চাল আমদানি করা হলে ভোক্তার কষ্টও লাঘব হবে।

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, বৈশ্বিক সংকটের এই মুহূর্তে কৃষির চাষাবাদকে নির্বিঘ্ন করতে কৃষকদের মাঝে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ, সার, বীজসহ নানাভাবে সহায়তা আরো বাড়ানো উচিত। যেন কৃষির উপর ভর করেই দুর্যোগপূর্ণ বর্তমান প্রেক্ষাপটকে সামাল দেয়া যায়। আর কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিকে সমৃদ্ধ করাও সম্ভব।

অবশ্য সরকার ইতিমধ্যেই প্রতিটি জেলায় টোলমুক্ত সুবিধায় কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য কৃষি মার্কেট খোলার ঘোষণা দিয়েছে। এ ঘোষণার সফল বাস্তবায়ন হলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্যও নিশ্চিত হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ কৃষকের স্বার্থে অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS