ভিডিও

ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহিদের মর্যাদা

মাও : মো: রায়হানুর রহমান

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪, ১০:৫২ রাত
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৪, ১১:৫৩ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

মহান আল্লাহর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মাতৃভাষা এ মানুষের জন্য মহান আল্লাহর এক অপার অনুগ্রহ। মানুষের হেদায়াতের জন্য পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁরা নিজ নিজ জাতির ভাষায়ই মানুষকে দীনের দাওয়াত দিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম  মানব ও প্রথম নবী হযরত আদম (আ) জান্নাতে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। পৃথিবীতে আসার পর তাঁর সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধি পেয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের ভাষা ও বর্ণে বৈচিত্র্যতা আসে।

পবিত্র কুরআনে ভাষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্যতা। এতে জ্ঞানী লোকদের জন্য অবশ্যই দৃষ্টান্ত রয়েছে। (সূরা রুম: আয়াত-২২)।  ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে,পৃথিবীতে আসার পর আদম (আ) আরবি ও সিরিয়াক ভাষায় কথা বলতেন। এর পরে শীষ (আ), নুহ (আ), ইউনুস (আ) ও ইদরিস (আ)ও সিরিয়াক ভাষায় কথা বলতেন।

হুদ ও সালিহ (আ) আরবি ভাষায় কথা বলতেন। ইবরাহীম (আ) এর মাতৃভাষা ছিল সিরিয়াক, তবে তিনি আরবি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন। ইউসুফ (আ)ও শৈশবে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। তবে মিসরে আগমনের পর প্রাচীন মিসরীয় ভাষা কিবতী ভাষায় কথা বলতেন। মূসা(আ) প্রাচীন মিসরীয় কিবতী ভাষায় কথা বলতেন, তবে মাদায়েনে হিজরত করার পর আরবি ভাষা রপ্ত করেন।

এভাবে নবী-রাসুলগণ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতেন এবং নিজ নিজ জাতির ভাষায় দীনের দাওয়াত দিতেন।মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করে পাঠিয়েছি, যাতে তাঁরা আমার কথা খোলামেলাভাবে লোকদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও তত্বজ্ঞানী। (সূরা ইবরাহীম: আয়াত-৪)।

আবার ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, নবী (সা) বলেছেন, আর ইসমাঈল (আ) যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের (জুরহুম গোত্রের লোকদের) থেকে আরবি ভাষা শিখলেন। (বুখারি: ৩৩৬৪)। নবী-রাসূল শুধু স্বজাতীর ভাষাভাষী ছিলেন তাই নয়, তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ভাষায় পান্ডিত্বের অধিকারী। সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী।

পবিত্র কুরআনে মূসা (আ) এর ভাষ্যে হারুন (আ) এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, আর আমার ভাই হারুন (আ) সে আমার চেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে। (সূরা ক্বাসাস: আয়াত-৩৪)। এসকল আয়াত ও হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা ও সাহিত্যের চর্চা এবং তাতে দক্ষতা অর্জন করা, মাতৃভাষায় দীনের দাওয়াত দেয়া নবীদের সুন্নাত।

আমাদের প্রিয়নবী (সা) মাতৃভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করে বলতেন, আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সা’দিয়া গোত্রে আমি মানুষ হয়েছি। তাদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাই আমি সর্বাধিক সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষা আত্মস্থ করেছি। (আল-বাদরুল মুনির ফি তাখরিজিল আহাদিস: ৮/২৮১)। পৃথিবীর সব ভাষাই মহান আল্লাহর সৃষ্ট। আর মাতৃভাষা মানবজাতির জন্য আল্লাহর দেয়া এক সুমহান নেয়ামত। পবিত্র কুরআনে এসেছে, পরম করুণাময় আল্লাহ, তিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে। তিনি তাকে ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন। (সূরা আর-রাহমান: আয়াত ১-৪)। এ আয়াতে মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষা শিক্ষার বিষয়টিও ফুটে উঠেছে। আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৯৫২ সালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।

ইসলামে নিজের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে নিহত মুমিনকে শহিদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহিদ। (বুখারি: ২৩৪৮, মুসলিম: ৩৭৮)। যেহেতু ভাষা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই ভাষার অধিকার রক্ষা করতে গিয়ে যে সকল মুমিন নিহত হয়েছে, তারাও শহিদ হিসেবে গণ্য হবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের অধিকার রক্ষা বা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিহত হয়, তার মৃত্যু খুবই ভালো মৃত্যু। (মুসনাদে আহমাদ: ১৫৯৮)।

তিনি (সা) আরো বলেন, যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়, সে ব্যক্তি শহিদ। (আহমাদ, সহীহুল জামে: ৬৪৪৭)। শহিদের মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনো মৃত মনে করো না বরং তারা জীবিত; তাদের প্রতিপালকের নিকট তারা জীবিকাপ্রাপ্ত হয়। (সূরা আলে-ইমরান: আয়াত-১৬৯)। পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পার না। (সূরা আল-বাকারাহ: আয়াত-১৫৪)।

হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহর নিকট শহিদের জন্য ছয়টি প্রতিদান রয়েছে, তার রক্তের প্রথম ক্ষরণের সাথে সাথে তার পাপ ক্ষমা করা হবে, জান্নাতে তার বাসস্থান দেখানো হবে, কবরের আযাব থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হবে, কিয়ামতের মহাত্রাস থেকে নিরাপত্তা পাবে, ঈমানের অলঙ্কার পরিধান করানো হবে, সুনয়না হুরীদের সাথে তার বিবাহ দেওয়া হবে এবং তার নিজ পরিজনের মধ্যে সত্তর জনের জন্য তার সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে। (আহমাদ: ১৭১৮২, তিরমিযি: ১৬৬৩)।

আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় যারা সংগ্রাম করেছেন, রক্ত ঝরিয়েছেন, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার, আমাদের উচিত সেসব মহান বীরদের জন্য মাগফিরাত কামনা করা। প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা বাধতামূলক করার মাধ্যমে তাদের ত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করা।

পাশাপাশি এই ভাষা যেন কল্যাণের বাহন হিসেবে, ইসলাম তথা শান্তির পয়গাম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে এর বিশুদ্ধতা সংরক্ষিত থাকে, সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায় সে চেষ্টা করা। আল্লাহ তায়ালা সমস্ত ভাষা শহিদকে পরকালে শান্তির আবাস দান করুন, আমীন।


লেখক : সহকারী শিক্ষক,
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া।

01739-850656



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS