ভিডিও

মানবিক সমাজের বিপরীতে অবসাদগ্রস্ত এক সমাজ

মোহাম্মদ নজাবত আলী

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৪, ১১:০৪ রাত
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৪, ১১:০৪ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

সেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ তার বুদ্ধি, শ্রম, মেধা-মনন দিয়ে যে সমাজ সভ্যতা গড়ে তুলেছে সে সমাজের আজ একি অবস্থা! সমাজ যেন দিনে দিনে দানব সমাজে পরিণত হচ্ছে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, নারী নির্যাতন নিত্য দিনের ঘটনা।

যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানবিক গুণাবলী- মন্যুষত্ব অর্জন সাধিত হয় সেখানেও যৌন নিপীড়ন এগুলো কিসের বার্তা বহন করে? অথচ আমরা নিজেদেরকে সভ্য বলে দাবি করি। কিন্তু আমরা কী সভ্যতার পাঠ গ্রহণ করেছি? হত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন এগুলো সভ্যতার লক্ষণ নয় বরং আমাদের বিকৃত মন ও রুচির পরিচয় বহন করে।

বর্তমান ও অনাগত প্রজন্ম এগুলো দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও হতে হবে। বর্তমান ও অনাগত প্রজন্মের জন্য সামাজিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে না পারলে ভবিষ্যতে এ সমাজ দানব সমাজে পরিণত হবে। তাই আজ ও আগামির প্রজন্মের পথচলা সুগম করতে হবে।

প্রায় প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা খুললেই সামাজিক অপরাধ ও অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখতে পাই। আমরা যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি রাষ্ট্রও। আমাদের সন্তান যে শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তা তাদেরকে কতটা মানবিক করে তুলছে সেটাও প্রশ্ন রাখে। মানুষ দিন দিন হিংস্র, নিষ্ঠুর বর্বর হয়ে উঠছে।

মানুষের মধ্যে এখন আর বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। মানবিকতা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। নীতি-নৈতিকতার পরাজয় ঘটছে। অথচ আমরা নিজেদের নীতিবান, সভ্য, সৎ, আদর্শবান বলে দাবি করলেও বর্তমান সামাজিক অপরাধের ভয়াবহ চিত্র তা প্রমাণ করে না। এ চিত্র শুধু সমাজের নয় গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার। একইসঙ্গে এ সমস্যা শুধু সামাজিক নয় এ সমস্যা রাষ্ট্রেরও।

একটি সমাজ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে শিক্ষার প্রসার লাভ করলেই বা শিল্প সাহিত্যের উন্নতি হলেই সব ঠিক আছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে এগুলো একটি দেশের অগ্রগতি, সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে।

প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে মানবিক চেতনা জাগ্রত হয়েছে কি না সামাজিক মূল্যবোধ ও শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে কি না সমাজের বখাটেদের উৎপাত বন্ধ সহ সর্বোপরী মানবিকবোধ সম্পন্ন সমাজ গড়ে উঠেছে কি না এদিকগুলো অবশ্যই ভাববার বিষয়।

কেননা এগুলোই সাধারণত একটি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সমাজ কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করায়। আজ স্বাধীনতার ৫২বছর পরও আমাদের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। ভঙ্গুর অবসাদগ্রস্ত এক সমাজে আমরা বাস করছি।

তাই আমাদের সমাজ কতটা এগিয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের চোখে সামাজিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ চিত্রই ভেসে উঠে। এ চিত্র হতাশার, এ চিত্র আশংকার, কারণ সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করেছে। হেন কোনো অপরাধ নেই যে, সমাজে ঘটছে না। নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে।

যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, বখাটেদের উৎপাতে স্কুল-কলেজগামী নারীরা আজ হত্যার শিকার হচ্ছে। আবার কখনো কখনো অশোভন আচরণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক নারী আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এসব ঘটনায় স্বজন হারানোদের আর্তনাদ আমাদের ব্যথিত করে।

সুস্থচিন্তা ও শুভবুদ্ধির বিপরীতে দিনে দিনে আমাদের সমাজটা ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। আসলে আমরা যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। যার বড় প্রমাণ প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নানা ধরনের অঘটন।

আজকের যুগে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার ও তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ উৎকর্ষে মানুষের বিবেক আবেক মনুষ্যত্ববোধ জাগরণের বিপরীতে লোপ পেয়েছে। মানুষ অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। তথ্য প্রযুক্তির কাছে সমর্পিত হয়েছে মানুষের আবেক বিবেক। তাই মানুষ অনেকটা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। ফলে আবেগের তাড়নায় সমাজে নানা অসংগতি বাড়ছে, সামাজিক অস্থিরতাও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে।

স্বাধীন দেশ হিসাবে আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যেভাবে এগিয়ে যাবার কথা বিশেষ করে স্বাধীনতার ৫২ বছরে তা এগিয়ে যায়নি। তবে শিক্ষাদীক্ষা, উন্নয়ন ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেশ এগিয়ে গেলেও সামাজিক নিরাপত্তা, স্স্থু মানসিকতা, নৈতিকতা, চরিত্রের উৎকর্ষতা সাধিত হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের যুগে আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের গুণগত পরিবর্তন আসবে। স্বাধীন দেশের সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের চরিত্র হবে উন্নত।

কিন্তু তা না হয়ে বরং ক্রমশ আমাদের পরিবার ও সমাজ নৈতিক অধ:পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ও নষ্ট রাজনীতির চোরাবালিতে প্রতিনিয়ত জনগণের নিরাপত্তা হচ্ছে বিঘ্নিত। সমাজে নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে। অপরাধের সঙ্গে বাড়ছে খুন খারাপি, নৃশংসতা। পৃথিবীর আদিমতম প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবার নামক সংগঠনটিতে মারাত্মক অধঃপতন ঘটছে।

সামাজিক নৃশংসতা গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলছে। সামাজিক অবক্ষয় বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। এমন কোনো অপরাধ নেই যা সমাজে ঘটছে না। তাই দেখা যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত অবলীলায়। ঘরে বাইরে, পথে-প্রান্তরে, কনসার্টে, কর্মস্থলে কোথাও নারী নিরাপদ নয়।

অনিরাপদ সমাজে মাদক নিয়ন্ত্রণ, নারী ও শিশু নিরাপত্তা আজও উপেক্ষিত। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের কঠিনতম আইন থাকা সত্ত্বেও নারী নির্যাতন রোধ করা যাচ্ছেনা। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ও উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ শিক্ষাক্ষেত্রে নারীরা অনেক এগিয়ে। রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা অধিষ্ঠিত।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ইতিবাচক পরিবর্তন হলেও নারীর নিরাপত্তার জায়গাটা এখনো অধরা। মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে রাষ্ট্রকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। আমরা সেই ধরনের মানবিক বোধ সম্পন্ন সমাজ চাই।

যে কোন দেশের অমিত শক্তি সম্ভাবনা হচ্ছে যুব বা তরুণ সমাজ। কিন্তু সে তরুণ সমাজ আজ বিপথগামী বিভ্রান্ত। একটি রাষ্ট্রে যদি তরুণদের মধ্যে অবক্ষয় নেমে আসে তাহলে সে সমাজ টিকে থাকা কঠিন। আমাদের তরুণরা আজ হতাশ এবং দিশেহারা। লেখাপড়া করেও ঘুষ না দিলে তারা চাকরি পাচ্ছে না। তরুণদের মধ্যে হতাশা থেকে জন্ম নিচ্ছে অপরাধপ্রবণতা।

ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুনোখুনি সহ বড় ধরনের অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তারা ক্রমাগতভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাছাড়া যুব সমাজের মধ্যে মাদকের ছড়াছড়ি। হতাশা থেকে মুক্ত, দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবনের দিকে তারা ঝুকে পড়তে ইয়াবা, মাদকসেবী হয়ে পড়ছে। তারা রঙ্গিন নেশায় নষ্ট করে দিচ্ছে সম্ভাবনাময় জীবনকে।

মাদকের কারণে দেখা যায় বিভিন্ন পরিবারে অশান্তি। এমনকি ভয়াবহ এ নেশায় তরুণ সমাজকে ভয়ঙ্কর করে তুলছে। তাদের কারণেই পরিবারে যেমন অশান্তি, তেমনি সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ বাড়ছে। এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের পরিত্রাণ দিবে এবং কে বা আমাদের পথ দেখাবে?

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজের যে অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু হত্যায় নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে শিশু অপহরণ ও ধর্ষণ হত্যাকান্ড বৃদ্ধিতে এ ধরনের অপরাধ থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে সমাজের অবক্ষয় দূর করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। মানুষ এখন বিশ্বায়নের যুগে প্রবেশ করায় নগরায়ন ও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামান্য কারণে সহপাঠী হত্যা, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, অপহরণের মতো অপরাধ।

তবে বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অত্যন্ত তৎপর এবং তারা অপরাধীদের শনাক্তকরণ এবং আইনের আওতায় আনতে অনেকটাই সক্ষম। তবে কথা হচ্ছে সমাজ থাকলে মানুষ থাকবে, অপরাধ সংঘটিত হবে। আবার জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আইন রয়েছে। কিন্তু একের পর এক খুনের মতো ঘটনা ঘটলেও অপরাধীদের শাস্তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় না।

বর্তমানে যেভাবে বিভিন্ন কারণে, আবার তুচ্ছ ঘটনাই এমনকি অকারণে সামাজিক অপরাধ, ক্ষেত্র বিশেষে পারিবারিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হচ্ছে তা কোনো ক্রমেই সমর্থনযোগ্য নয়। অপরাধীদের শান্তি নিশ্চিত করতে না পারলে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এব্যাপারে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।

যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, যারা রাষ্ট্রের কর্ণধার তাদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও আইনের যথাযথ প্রয়োগই হচ্ছে কার্যকর ব্যবস্থা। আর এ ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তবে রাষ্ট্র এ ব্যাপারে যথেষ্ট সোচ্চার। 
আমরা বলে থাকি নতুন প্রজন্ম আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

কিন্তু নতুন প্রজন্ম আজ কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে। নতুন প্রজন্মের জন্য যদি সুন্দর, সুস্থ, সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা না যায় তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র দেখতে দেখতে তারা বেড়ে উঠবে। তাদের সামনে ঘটে যাচ্ছে, যাবে- খুন, যখম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন সহ নানা ধরনের সামাজিক অবক্ষয়। তাদের কোমল মনে কি দাগ কাটবে না ? সারাটি জীবন তাদের তাড়িত করবে এ ভয়াবহ স্মৃতি।

শুধু নারী নির্যাতনের ঘটনায় নয়, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল সহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য পান করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে আজকের তরুণ সমাজ। বেকারত্ব অভাব-অনটন, নৈতিক শিক্ষাবোধের অভাব, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দিন দিন আমাদের সমাজ এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ছে অপরাধ। ফলে নারী নির্যাতন যৌন হয়রানী, ধর্ষণ, নিপীড়ন সহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোনো সমাজে শৃঙ্খলা না থাকলে বিভিন্ন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক, সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিবে।

মানুষের মানবিক গুণাবলি সুকুমার বৃত্তির বিবেক, মনুষ্যত্ববোধ প্রভৃতি লোপ পেয়েছে। সে বিবেকের জাগরণ দরকার। অধঃপতিত সমাজ, পরিবার, সামাজিক মূল্যবোধের পুনঃজাগরণের জন্য প্রয়োজন মানবিক মূল্যেবোধ, জনসচেতনতা।

এ জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। সামাজিক অবক্ষয় রোধে পথভ্রষ্ট বিপথগামীদের শুনাতে হবে জাগরণের বাণী। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে পথভ্রষ্ট যুব সমাজকে জাগাতে হবে। শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাতে হবে। তবেই, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ আজ ও আগামীর পথচলা সুস্থ, সুন্দর, ও নিরাপদ হবে।


লেখক : সাবেক শিক্ষক ও কলামিস্ট

tnalichs@gmail.com

01719-536231



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS