ভিডিও

বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে বিশ্বদর্শন

এড.মোঃ মনতেজার রহমান মন্টু

প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২৪, ০৫:৩৯ বিকাল
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৪, ১০:১৮ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো, তিনি আমাদের জাতিসত্তাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ভূ-খন্ড যেটি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে এবং সৃষ্টির পর প্রথমে ‘পূর্ব বাংলা’ এবং পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল। আবার সেটিকে ১৯৬৯ সালে ‘বাংলাদেশ’ নামে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই চেতনাটি উপেক্ষা করে।

এদেশের রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করার পিছনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অনন্য। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আবার আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ রূপান্তর এদেশের রাজনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মুজিবের রাজনৈতিক জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বঙ্গবন্ধু কার্যত বর্জন করেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বকে, আর তাই পাকিস্তান আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব তাঁকে এতোটুকু আকর্ষণ কিংবা আপোষের পথে টানতে পারেনি। মুসলিম সরকারের নির্বাচনী আইনে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে মুসলমান এবং অমুসলমান নাগরিকদের পৃথক ভোটাধিকার (সেপারেট ইলেক্টোরাল) প্রয়োগের নিয়ম ছিল। এটাই বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীর পছন্দ ছিল না।

এই সাম্প্রদায়িক নিয়মের প্রতিবাদ করেই আওয়ামীলীগ সহ বিভিন্ন দল যুক্তফ্রন্ট নামে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এতোটাই বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল যে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিম লীগের নাম নিশানা মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অতঃপর ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিবর্তন করে অসাম্প্রদায়িক/ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ভিত্তিতে ‘আওয়ামীলীগ’ নাম করণ করা হয়েছিল।

সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে কি জ্বালা যন্ত্রণা নির্যাতন তা বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগ বুঝতে পেরেই স্বাধীনতার পর প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশ সরকার সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু মুজিব আশা করেছিলেন, ধর্মীয় ইস্যুতে সৃষ্ট বিবদমান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ একটি “Buffer state” হিসাবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড স্বরূপ অবস্থান করবে। কিন্তু এ সুন্দর প্রত্যাশা সফল হয়নি।

কারণ সপরিবারে জাতির পিতা মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পরবর্তী ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় এসে সামরিক শাসকেরা ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি ধর্ম-নিরপেক্ষতার নীতি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আলজিয়ার্স গিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানকার দু’টি সাক্ষাৎ তুলে ধরছি এম আর আকতার মুকুলের ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত লাল’ বইটি থেকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ করে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মোয়াম্মের গাদ্দাফি হঠাৎ করেই প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রির সাথে ‘আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধুত্ব’ করতে চাই।

কিন্তু এ বিষয়ে শর্ত হচ্ছে, তাঁকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম বদলিয়ে ‘বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ করতে হবে। জ¦লন্ত পাইপ থেকে একরাশ ধূয়াঁ ছেড়ে স্মিতহাস্যে বিনয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘এ ধরনের প্রস্তাব আমার পক্ষে কার্যকরী করা সম্ভব নয় বলে আমি দুঃখিত। কারণ সমগ্র লিবিয়ার যেখানে অমুসলিম জনসংখ্যা নেই বললেই চলে, সেখানে বাংলাদেশে অমুসলিমদের সংখ্যা এক কোটির মতো।

এক্সেলেন্সি, পরমকরুণাময় আল্লাহ তায়ালা তো শুধু আলমুসলেমিন নন তিনি তো রাব্বুল আলামিন। দ্বিতীয় সাক্ষাৎকার সৌদির বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে। বাদশাহ শুরুতেই বললেন, আমি শুনেছি যে, আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছে থেকে কিছু সাহায্য প্রত্যাশি। অবশ্য সাহায্য দেয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্ব শর্ত রয়েছে। সৌদি স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ করতে হবে।

মুজিব জবাব দিয়েছিলেন এই শর্তটা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এদেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম জনসংখ্যা রয়েছে। সবাই একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের শরীক হয়ে দুর্ভোগ পোহায়েছে। তাছাড়া, এক্সেলেন্সি, আল্লাহ তায়ালা....আলামিন। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর অধিকর্তা।

আপনার দেশটির নামও তো ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি এ্যারবিয়া’ নয়......কিংডম অব সৌদি এ্যারবিয়া। কই আমরা তো কেউ এর আপত্তি করি না। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন-এক্সেলেন্সি বেয়াদবী নেবেন না-আমার তো মনে হয় না, মিসকি’নের মতো বাংলাদেশ আপনার কাছে কোনো সাহায্য চেয়েছে।

কিন্তু বৈঠক সমাপ্তির ঠিক আগে গভীর ধর্মবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী উন্নতশির বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করে ছিলেন, ‘লা-কুম দ্বিনকুম ওয়ালি ইয়া দ্বিন’-তোমার ধর্ম তোমার আমার ধর্ম আমার। এটা ইসলাম ধর্মেরই অন্যতম মর্মবাণী।


লেখক : আইনজীবী ও কলামিষ্ট

01711-425981



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS