ভিডিও

শূন্য ভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থার সুফল

প্রফেসর মুহা. সুজন শাহ-ই-ফজলুল

প্রকাশিত: এপ্রিল ০১, ২০২৪, ০৫:৪৬ বিকাল
আপডেট: এপ্রিল ০১, ২০২৪, ০৫:৪৬ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বার্ষিক বাজেট সরকার বা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক দলিল। বাস্তবতা বিবেচনা না করে প্রণীত বাজেট অনেক সময় দেশের জন্য কাক্সিক্ষত সুফল বয়ে আনে না। বার্ষিক বাজেট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না, ফলে একদিকে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পায় অন্যদিকে জনগণ প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

সনাতন বাজেট ব্যবস্থার আর একটি দূর্বলতা হলো কোন প্রকার বিশদ পর্যালোচনা না করে যেনতেনভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও বাজেট বরাদ্দ। বছর শেষে দেখা যায় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা সম্ভব হয় না বিধায় সংশোধিত বাজেট বা বাজেট কাটছাট করা হয়, যা কোনভাবে কাম্য নয়।

দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সক্ষমতা বিবেচনা না করে প্রকল্প গ্রহণ ও বর্জন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দক্ষতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয় অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে সম্প্রতি দুটি উদাহারণ সকলের বোঝার জন্য যথেষ্ট। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চলের জন্য নির্মিত পদ্মা সেতুতে নতুন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।

বিষয়টি ঐ অঞ্চলের জনগণের জন্য আনন্দের বিষয় কিন্তু প্রয়োজনীয় লোকবল, রেল ইঞ্জিন ও রেল কোচের ব্যবস্থা না থাকায় ঐ অঞ্চলের জনগণ রেলসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু সরকারের ঐ প্রকল্পের জন্য গৃহিত ঋণের কিস্তি প্রদান বন্ধ থাকবে না।

গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় উদ্বোধনের ৮ বছর ধরে জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ এর যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় এসব যন্ত্রপাতি অযত্ন অবহেলায় বাক্সবন্দি আছে বলে জানা গেছে।

এ রকম বাক্সবন্দির সংবাদ কেবল জামালপুর নয় দেশের বড় বড় মেডিকেল কলেজে এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সত্য। স্বাস্থ্যখাত ও অন্যান্য খাতের বিদ্যমান অব্যস্থাপনার মূল কারণ সনাতন বাজেট ব্যবস্থা ও দূর্বল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। সনাতন বাজেট ব্যবস্থায় বাংলাদেশে যে বাজেট প্রণয়ন করা হয় তা সাধারণত বিগত বছরের বাজেটের ৫% থেকে ১০% অর্থ বৃদ্ধি করে আগামী বছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়।

এ ব্যবস্থায় অর্থের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা অনেক ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় না। শুধু তাই নয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বন্টিত হয় বছরের শেষ পর্যায়ে। বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে ফেরত না যায় তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুবই দ্রুততার সঙ্গে ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে  দূনীর্তির সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং অর্থের অপচয় হয়।

সরকারের বাজেটের লক্ষ্য শুধু সরকারের আয় ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ নয়। লক্ষ্য হলো দেশের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাজেট সম্পর্কে তত্ত্বের দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। শুধু তত্ত্বই পরিবর্তন হচ্ছে না, পরিবর্তিত হচ্ছে বাজেট উপস্থাপনার হাতিয়ারসমূহ অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্র ব্যাপক হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে বাজেটের আকার বাড়ছে।

আইনত বাজেট পাশের ক্ষমতা জনপ্রতিনিধিদের হাতে দেয়া হয়েছে কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা এ ক্ষমতা সার্বিকভাবে প্রয়োগ করতে পারে না। প্রভাবশালী রাজনীতিক বা অনেক ক্ষেত্রে বাজেটে অর্থ বন্টনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সমতা ভিত্তিক সম্পদ বন্টন অনেক সময় বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। যেমন শিক্ষামন্ত্রী চাইবেন নিজ জেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন।

কোনটাতেই জনগণের আপত্তি নেই তবে বাজেট ব্যয়টা হতে হবে জনগণের প্রয়োজন ও চাহিদাভিত্তিক, ব্যক্তির পছন্দ অনুযায়ী নয়। সনাতন বাজেট ব্যবস্থার এই দুর্বলতা দুর করার জন্য শূন্য ভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থা উদ্ভব হয়েছে। শূন্যভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এরকম ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে শূন্য ভিত্তিক বাজেট কৌশল প্রয়োগ করে।

এটি সাধারণ বাজেট ব্যবস্থার অতিরিক্ত একটি উচ্চতর প্রয়োগ। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থার আরও উন্নত কৌশল আবিষ্কার করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে তার নিজ প্রতিষ্ঠানে প্রয়োগ করে। এই বাজেট ব্যবস্থার বিষয়ে জর্জিয়ার তদানিন্তন গভর্নর জিমি কার্টার অবগত হলে জর্জিয়ায় তিনি এই প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাজেট প্রণয়ণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে মি. জিমি কার্টার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ফেডারেল বাজেট ব্যবস্থায় তিনি শূন্যভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থা কৌশল সফলভাবে প্রয়োগ করেন। জিমি কার্টার জর্জিয়ায় যখন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তখন ঐ রাজ্যের ৬৫টি গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানকারী বিভাগ বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিল।

সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি ও জননিরাপত্তা। কোভিডকালীন সময় থেকে ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দিষ্ট কিছু বিভাগে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে শূন্য ভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থা প্রয়োগ করে এবং এর সুফল ভোগ করছে।

এই প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণয়নকালে প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবকিছু শূন্য বা কিছু নাই বা ছিলনা ধরে আগামী বছরের বাজেট প্রণয়ন করা হয়। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে গত বছর কত বরাদ্দ ছিল তাও ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এই ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট খাতে খরচ করলে কি ঘটবে? যদি খরচ না করা হয়, তাহলে কি ঘটবে এটাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

বাজেট প্রণয়নকালে প্রতিটি বিভাগ, দপ্তর বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী প্রতি প্রকল্পের কষ্ট বেনিফিট বিশ্লেষণ করবে এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিটি প্রকল্পের জন্য সে ব্যক্তিগতভাবে দায়ি থাকবে। এই পদ্ধতিতে বাজেট প্রণয়নকালে নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর সতর্ক দৃষ্টি দেয়া হয়। যেমন কেন ব্যয় করা হবে? কোথায় ব্যয় করা হবে? কি পরিমাণ ব্যয় করা হবে? ব্যয়ের যৌক্তিকতা কী? কিভাবে ব্যয় করা হবে? ব্যয়ের প্রতিদান কি? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে কোন জেলা সদর হাসপাতালে স্থানীয় এমপি মহোদয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি ডিও লেটার দিল।

ঐ হাসপাতালে এমআরআই মেশিন বরাদ্দের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উক্ত প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট বিভাগে বিষয়টি বাজেটে অর্ন্তভুক্ত করে বাজেট বরাদ্দের সুপারিশ করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে শূণ্যভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থার প্রচলন থাকলে ডিও লেটারের ভিত্তিতে এমআরআই মেশিন বরাদ্দের কোন সুযোগ নাই। স্বাস্থ্য বিভাগের বাজেট শাখার টেকনিক্যাল কমিটি প্রথমে দেখবে জেলা সদর হাসপাতালে এমআরআই মেশিন দরকার আছে কিনা। স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কক্ষ আছে কিনা।

রেডিওলোজিস্টসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, মেশিন অপারেটরের পদ আছে কিনা সব প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে প্রদত্ত চাহিদাকে র‌্যাংক প্রদান করবে। যদি প্রস্তাবটি ‘এ’ র‌্যাংক অর্জন করে তবেই বাজেট অনুমোদিত হবে। র‌্যাংক ‘বি’ ও ‘সি’ হলে পরবর্তীতে বিবেচনার জন্য রেখে দেয়া হবে। আমরা সবাই স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলি। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে স্মার্ট বাজেট ব্যবস্থার প্রবর্তন অপরিহার্য।

অপচয় রোধে শূন্যভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থা একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক বাজেট ব্যবস্থা। যদি এই মুহূর্তে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। কারণ এটি বাস্তবায়নে দক্ষ জনবল ও অভিজ্ঞ বাজেট কর্মী, টেকনিক্যাল লোকের প্রয়োজন হয় তা বর্তমানে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তাই পাইলট প্রকল্প হিসেবে একটা মেডিকেল কলেজ, একটা জেলা হাসপাতাল, ২টি উপজেলা হাসপাতাল নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে শূন্যভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

তিনি একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি অবগত। অপচয়রোধে তিনি প্রস্তাবিত বাজেট বিষয়ে কার্যকরি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবেন বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক:  ট্রেজারার, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বগুড়া।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS