ভিডিও

বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকতা

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৪, ০৫:৩৯ বিকাল
আপডেট: এপ্রিল ১৬, ২০২৪, ০৫:৩৯ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বঙ্গবন্ধুর কথায় বলতে হয় “সোনার দেশের জন্য চাই সোনার মানুষ” সোনার মানুষ তো হবে সব দিক থেকে যোগ্য ও পরিপক্ক। যেমন সোনার ও শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে রক্ষা করে ছিলেন। আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিজ্ঞান ও টেকনোলোজির সর্বোচ্চ পর্যায়ে সারা পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে।

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি গ্লোবাল পরিমন্ডলের একটি অংশ। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদেরও একই গতিতে চলতে হবে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম বাংলাদেশে একটি বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন বক্তৃতায় বলেছিলেন দেশের আভিজাত্যের বহি:প্রকাশ বুঝা যায় সেই দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে প্রত্যেক বছর কতগুলি গুণগতমান সম্পন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত জরিপে দেখা যায় র‌্যাংকিং এর দিক থেকে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই।এই র‌্যাংকিং এর একটি বড় ক্রাইটেরিয়া হল গবেষণা ও গুণগত মানের গবেষণাপত্র প্রকাশ। বিশ্ববিদ্যালয় তথা উচ্চ শিক্ষার আধুনিক গবেষণার কনসেপ্ট আমাদের দেশে প্রবর্তন হয় ব্রিটিশ শাসনামলে।

এই উপমহাদেশে প্রথম ১৮৫৭ সালে ২৪ শে জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। তারও ৬৪ বছর পর ১৯২১ সালে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ব্রিটিশদের হাতেই। আর পাকিস্তান শাসনামলের ২৩ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৮। অর্থাৎ ব্রিটিশের সময় ১টি এবং পাকিস্তানের সময় ৫টি মোট ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে স্বাধীনতার ৫৪ বছরে ৫২টি সরকারি ও ১১৩টি বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুণগত মান বিবেচনায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সময় খুবই প্রতিবিধান যোগ্য।

এত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কি বাড়ছে না কমছে তা আমাদের সবারই জানা। সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা গাণিতিক থেকে জ্যামিতিক হারে বাড়লেও গুণগত মানে কি পরিবর্তন হয়েছে তা সবারই জানা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ফলাফল দেশের মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো।

দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হবেন এবং মুক্তজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সমাজ ও মানব জাতির উন্নয়নে প্রগতিশীল সকল দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন। দেশে এখন বিভিন্ন ক্যাটাগরির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাথে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিটেস বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এখনও পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।

বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি উল্লেখ আছে। আশা করছি অচিরেই তা বাস্তবায়ন হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সাংখ্যিক বৃদ্ধির সাথে সাথে গুণগতমান বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতি হিসাবে বিশ্ব দরবারে মাথা হেট হতে বাধ্য। যখন (এমআইটি) বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় উঁচু মাথায় বলবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য কতগুলো নোবেল অর্জন করেছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও একই ভাবে গর্বভরে যখন বলবে আমাদের গবেষণায় বিশ্বের প্রগতিতে এই ভূমিকা রেখেছে । ঠিক সেই  মুহূর্তে আমাদের অর্জন কি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘটনায় ম্লান হয়ে যায় না। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভূত গবেষণার ফলাফলে আমরা অনেকগুলো সূচকে বিশ্বদরবারে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছি। জাতিসংঘ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেরেস উপাধিতে ভূষিত করেছেন। আমরাও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।

মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদনেও বিশ্বের তালিকায় আমরা শীর্ষের দিকে অবস্থান করছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান আর মেধা চর্চার জায়গা যদি অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হয়, তবে তা হবে জাতি হিসাবে বড়ই দুর্ভাগ্যের। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বিদ্যাপিঠ বাংলাদেশের কৃষি শিক্ষার আঁতুরঘর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন করার।

আমার মনে পড়ে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য় বর্ষের ছাত্র তখন জাপানের হুক্কাইডু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। ওনার লেকচারে ওনি বলেছিলেন প্রফেসরের উৎপত্তি হয়েছে প্রোফেট থেকে। কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বুঝেছিলাম একজন প্রফেসর কখনই মিথ্যে বলতে পারেন না।

কখনই অমূলক কোন কাজ করতে পারেন না। কোন হয়রানি তো অনেক দূরের কথা একজন প্রফেসরের প্রতিটা অঙ্গভঙ্গিই অনুকরণীয়, অনুসারীর। একজন ঐশি বাণী বাহক যেমন কখনই তাঁর অনুসারীর কোন অনিষ্ট ভাবতেও পারেন না। তাঁরা শুধুই চিন্তা ও আরাধ্য হল অনুসারীর সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা। চারিত্রিক উত্তম বৈশিষ্ট্য দ্বারাই আকৃষ্ট হবে তাঁর অনুসারী।

একই ভাবে একজন অধ্যাপক তাঁর ছাত্র/ছাত্রীদের চাল, চলন, বিনয়, ভদ্রতা, নম্রতা, বাস্তবতা, মানবিকতা, সততা, ন্যায়পরায়নতা, নৈতিকতা, মানবতা, শিখানোর পুরোধা। তাঁর ব্যবহার ও কার্যক্রম দিয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের আইডল বা আইকনে পরিণত হবেন। জীবনে চলার পথে সঠিক দিক নির্দেশনা ও তার বাস্তবায়নের আধার যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয় তবে তার সঠিক নির্দেশক হলেন শিক্ষক। অধ্যাপকরা যেমন জীবন দর্শন শেখাবেন, দর্শনের বাস্তবতা কতটা সহজ কতটা কঠিন তার পুরোটাই পাওয়া যাবে তাঁর প্রতিটি কর্মে।

তাঁর গবেষণা যেমন ত্বরান্বিত করবে সমাজকে, মানুষের ভাগ্যকে ঠিক তেমনি তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ এবং কৃত প্রতিটি কর্ম উদ্ভাসিত করবে তাঁর প্রতিটি ফেলোকে। এখানে কোন অপ্রত্যাশিত নোংরা চিন্তাভাবনার কোন স্থানই নেই। যে চিন্তার আলেখ্য ও জীবন দর্শনে একজন মহামানব তাঁর অনুসারীকে দীক্ষা দিবেন, পথ দেখাবেন সঠিকতার। সেই জীবন দর্শনই প্রতিফলিত হবে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে। শিক্ষার্থী নিজেকে সেই উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করবেন।

এটা হয় না। হতে পারে না। মনে রাখা দরকার সৃষ্টিকর্তা কখনই সবাইকে ঐশিবাণী প্রদান করে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। খুবই সিলেকটেড ও পরিপূর্র্ণভাবে আদর্শিক চরিত্রের ব্যক্তিই বাণী বাহক হিসাবে নির্বাচিত হন। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে যদি আমরা এভাবে চিন্তা করি। এটা একটা গুরু দায়িত্ব  মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক মহান কর্মযজ্ঞ।

এই দায়িত্বে ব্যত্যয় ঘটলে শুধু যে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানবতা, মানবিক আদর্শের। প্রগতিশীল গ্লোবাল ভিলেজে গুরুত্বপূর্ণ যে অবদান রাখার কথা তা তো বিলীন হবেই। স্তম্ভিত হয়ে পড়বে মানবতা।

সেকটর ওয়াইজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে যদি সুনির্দিষ্ট গবেষণা জোরদার করা যায়, তাহলে আমরাও গর্ব করে বলতে পারবো ওমুক ফিল্ডে আমরা অমুক ভূমিকার জন্য এতটা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। বিশ্ব উপকৃত হবে আমাদের কর্মকান্ডে। বিকশিত হবে মানবতা। আমরা হয়ে উঠবো সোনার মানুষ আর বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা।


লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS