ভিডিও

ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

মাও : মো: রায়হানুর রহমান

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ০৭:০৩ বিকাল
আপডেট: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ০৭:০৩ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভাই ভাই সম্পর্ক রক্ষা করাকে বলে ভ্রাতৃত্ববোধ। আর সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রেখে চলাকে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। মহান আল্লাহ বলেন, হে মানবমন্ডলী! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার।

প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে সেই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে বেশি আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন। (সূরা হুজরাত: ১৩)।

ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে তিন ধরনের ভ্রাতৃত্ব দেখা যায়। আদম ও হাওয়া (আ) এর সন্তান হিসেবে বিশ্বের সব মানুষই ভাই ভাই (যাকে বলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব), একই পিতা-মাতার সন্তান হলে ঔরশজাত ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব তাকে বলে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। (এক) বিশ্বভ্রাতৃত্ব: বিশ্বের সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একজন ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন।

আর এ দু’জন থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষ ছড়িয়ে দিয়েছেন।(সূরা আন-নিসা: ০১)। মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, আমি আদম (আ) এর বংশধরকে (সকল সৃষ্টির উপর) মর্যাদা দিয়েছি। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৭০)। মহান আল্লাহ আরো বলেছেন, আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি। (সূরা আত-তীন: ০৪)। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সকল মানুষ আদম (আ) হতে এসেছে, আর আদম মাটির তৈরি। (তিরমিযি)। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার সকল সৃষ্টির মধ্যে মানুষের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি।

তাই সকল মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা, তাদের অধিকার আদায় করা ইসলামের নির্দেশ। একবার এক ইহুদির ছেলে অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাকে দেখতে যান। তিনি বালকটিকে ইসলাম কবুল করতে বলেন। বালকটি পিতার অনুমতি নিয়ে ইসলাম কবুল করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি আমার কারণে ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করলেন। (আবু দাউদ: ৩০৮২)।

কাজেই যদি কোন অমুসলিম অসুস্থ হয় তাকে দেখতে যাওয়া, ভালো কাজে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। তবে কেউ অন্যায় করলে সে যদিও মুসলিম হয় তারও প্রতিবাদ করতে হবে। উবাদা ইবনে সামিত (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) নির্দেশ দিয়েছেন যে, কারো ক্ষতিও করা যাবে না এবং কারো ক্ষতি সহাও যাবে না। (ইবনে মাজাহ: ২৩৪০, আহমাদ: ২২২৭২)।

আবু বক্কর সিদ্দীক (রা) সূত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সমাজের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্টকারী, কৃপণ এবং দান করে খোটাদানকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (তিরমিযি: ১৯৬৩, আহমাদ)। আবু সিরমা (রা) সূত্রে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করবে আল্লাহ তার ক্ষতি করবেন এবং যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দিবে আল্লাহ তাকে কষ্ট দিবেন। (তিরমিযি: ১৯৪০, আবু দাউদ: ৩৬৩৫)। সুতরাং যে ধর্মের, যে জাতির, যে এলাকারই হোক না কেন, কোন মানুষের ক্ষতি করা ইসলামে নিষিদ্ধ।

বরং হিংসামুক্ত অন্তরে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। আনাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে বলেন, বৎস, যদি পার এমনভাবে সকাল ও সন্ধ্যা করবে (জীবন কাটাবে) যে, তোমার হৃদয়ে কারো প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা অমঙ্গলের ইচ্ছা নেই। এটাই আমার সুন্নাত।

যে আমার সুন্নাতকে জীবিত করল, সে আমাকে ভালবাসল। আর যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (তিরমিযি: ২৬৭৮)। মদিনায় হিজরতের পর সেখানকার ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিকসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে মহানবী (সা) একটি রাষ্ট্র গঠন করেন, যা পরিচালনার জন্য একটি মদিনা সনদ নামে সংবিধানও প্রণয়ন করেন। এতে সকলের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে।

তাই বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলা প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। (দুই) ঔরশজাত ভ্রাতৃত্ব: একই পিতার ঔরশে কিংবা একই মায়ের গর্ভে যাদের জন্ম তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে ঔরশজাত ভ্রাতৃত্ব বলে। এ সম্পর্ক রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরজ।

অথচ আজকাল আপন দুই ভাই কিংবা ভাই-বোনের মধ্যেও হিংসা-বিদ্বেষ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। পিতার মৃত্যুর পর একে অন্যের সম্পদ আত্মস্যাৎ করে নেয়। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ওয়ারিশকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে জান্নাতের অংশীদার হওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন। (ইবনু মাজাহ: ২৭০৩)।

আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলের ফিরিস্তি (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। (অপর বর্ণনায় জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়- সহিহ মুসলিম ঃ ৬৩১২) তখন আল্লাহ জাল্লা শানুহু এমন বান্দাকে ক্ষমা করে দেন, যারা তার সাথে কাউকে শরিক করে না। তবে এমন বান্দাকে ক্ষমা করেন না, যার ভাই ও তার মধ্যে শত্রুতা আছে। তখন বলা হয়, এদেরকে অবকাশ দাও যতক্ষণ না এরা পরস্পর মীমাংসা করে নেয়।

এদেরকে অবকাশ দাও যতক্ষণ না এরা পরস্পর মীমাংসা করে নেয়। (সহিহ মুসলিম ঃ ৬৩১৩)। কাবিল তার আপন ভাই হাবিলকে হত্যা করতে চাইলেও হাবিল তার ভাইকে আঘাত করেনি। পরে হাবিলকে হত্যা করে কাবিলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ হত্যা করা হবে প্রত্যেকের পাপের সমপরিমাণ অংশ কাবিলের আমলনামায় যেতে থাকবে।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, (ন্যায়পরায়ণ শাসকের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ ও রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার মতো মারাত্মক আর কোন পাপ নেই, আল্লাহ তায়ালা যার শাস্তি পৃথিবীতেও প্রদান করেন এবং আখিরাতের জন্যও অবশিষ্ট রাখেন। (তিরমিযি: ২৫১১, ইবনু মাজাহ: ৪২১১)। ঔরশজাত ভাইয়ের প্রতি আমাদের আচরণ হওয়া উচিত হযরত ইউসুফ (আ) এর মতো। ছোটবেলায় যদিও ভাইয়েরা তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েও তিনি তাঁর ভাইদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।

(তিন) ইসলামি ভ্রাতৃত্ব: লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা)- এই কালিমায় বিশ্বাসী লোকদের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব তাই ইসলামি ভ্রাতৃত্ব। মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পরের ভাই, তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। (সূরা হুজরাত: ১০)। তিনি আরো বলেন, আর মুমিন নর ও মুমিন নারী সকলেই একে অন্যের বন্ধু। (সূরা আত তাওবা: ৭১)।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মুমিনের দৃষ্টান্ত একটি দেহের ন্যায়, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ¦র ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়। (সহিহ বুখারি: ৬০১১, সহিহ মুসলিম: ২৫৮৬)। রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। একজন আরেকজনকে জুলুম করে না এবং বিপদে পরিত্যাগ করে না।

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে ব্যস্ত থাকবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মেটাতে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের কষ্ট-বিপদ দূর করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন। (সহিহ বুখারি: ২২৭৮, সহিহ মুসলিম: ৬৩৪২)।

অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে হাঁটবে তা তার জন্য দশ বছর ই’তিকাফ করার চেয়েও কল্যাণকর হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি দিন ই’তিকাফ করবে, আল্লাহ তার ও জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক খন্দকের প্রশস্ততা হবে দুই দিগন্তের (পূর্ব-পশ্চিমের) দূরত্বের চেয়েও বেশি। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৩৬৭৯, তাবারনী, মু’জামুল আওসাত: ৭৩২৬)। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে মহানবী (সা) কর্তৃক আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে স্থাপিত ভ্রাতৃত্ব। আনাস ইবনে মালেক (রা) এর বাড়িতে একদিনেই নব্বইজন (আনসার ও মুহাজির)সাহাবির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা হয়।

আনসাররা উদার মনে মুহাজির ভাইদেরকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়াসহ সম্পদের অংশ প্রদান করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, মুমিন ঐ ব্যক্তি যে নিজে অন্যদেরকে ভালবাসে এবং অন্যরাও তাকে ভালবাসে। যে ব্যক্তি নিজে অন্যদেরকে ভালবাসে না এবং অন্যরাও তাকে ভালবাসে না তার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। (আলবানী, সহিহুল জামে’)।

রাসুলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি নিজের জন্য যা পছন্দ করে সেটা তার ভাইয়ের জন্যও পছন্দ না করা পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না। (তিরমিযি: ২৫১৫, ইবনু মাজাহ: ৬৬)। রাসূলুল্লাহ (সা) আরো বলেন, প্রকৃত মুসলিম সেই যার জিহবা ও হাতের ক্ষতি থেকে অন্য মসুলিম নিরাপদ থাকে। (সহিহ বুখারি: ১০)।

সুতরাং কোন মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করা কখনই কোন মুসলিমের জন্য শোভনীয় নয়। সত্য ও ন্যায়ের পথে সকলের সাথে সহযোগিতা আর পাপ ও গুণাহের কাজে অসহযোীতা করা ইসলামের নীতি। সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম। কোন অমুসলিমের শিরকী কাজে যেমন সহযোগিতা করা যাবে না, তেমনি কোন মুসলিমকেও চুরি-ডাকাতিসহ কোন খারাপ কাজে সহযোগীতা করা যাবে না।

মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা তাকওয়া ও ন্যায় কাজে পরস্পরের সহযোগিতা করো। পাপাচার ও অন্যায় কাজে সহযোগীতা করো না। (সূরা মায়িদা: ০২)। আসুন আমরা সবাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা) এর নির্দেশ মতো ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে চলি।


লেখক : সহকারী শিক্ষক, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন
পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া।

01739-850656



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS