ভিডিও

সফলতার সংজ্ঞা এবং বাস্তবতা

মামুনার রশীদ

প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ১১:১৯ রাত
আপডেট: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ১১:১৯ রাত
আমাদেরকে ফলো করুন

দীর্ঘপথ ঢাকা ঔর্ণে/শেষে উঠে যাচ্ঞা ফড়িঙে/ঊর্ধ্বরেতাঃ ওঁৎ ঋভু মাঝখানে /এই অডং জটলা ছই সহায় আগঢ় ঐ। এটি বাংলা ভাষার সবচেয়ে ছোট্টকাব্য। যা লিখেছেন বিশিষ্ট লেখক ও আধ্যাত্মিক গবেষক বলন কাঁইজি। কবিতাটির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো বাংলা বর্ণমালার ৫০টি অক্ষর প্রতিটি একবার করে ব্যবহার করা হয়েছে। এই কবিতাটিকে বাংলা ভাষার যুগান্তকারী অবদান বলা হয়। ইংরেজি ২৬টি অক্ষরেও একটি বাক্য আছে A Quick brown fox jumps over the lazy dog. কিন্তু এ বাক্যে সাতটি অতিরিক্ত বর্ণ আছে।

সুতরাং, বাংলা ভাষার সকল বর্ণে রচিত এক অনুপম কবিতার নাম বঙ্গবর্ণ যা রচনা করেন বলন কাঁইজি কিন্তু আমরা তাঁকে মোটেও চিনি না। অথচ তিনি একবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, গবেষক। এ পর্যন্ত তাঁর আত্মদর্শনমূলক প্রায় ত্রিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এখন বলি উপরে উল্লেখিত কবিতাটির অর্থ।- ‘জীবন চলার পথ অসংখ্য বিপদাপদ সদৃশ লোম দ্বারা আচ্ছাদিত।

কপট ও অসৎ লোকেরা সরল মানুষগুলোকে ঠকানোর জন্য ফড়িঙের মতো চতুর্দিক হতে ছুটে আসে। সুবিজ্ঞ অটল ও মহাজ্ঞানী সাধুগণ সবসময় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। জীবনে সফলতা অর্জন করতে হলে প্রত্যেকের উচিত সাধু মহৎগণের মতো মধ্যম পন্থাকে আগড় বা সিঁদকাটি রূপে ধারণ করা। ৫০টি অক্ষরে লেখা ছোট্ট কবিতাখানির অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল! এ কারণেই বুঝি ভাব সম্প্রসারণ ছিল, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিবে তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।

আজকের এই বঙ্গবর্ণ কবিতাটি আমার কাছে এ কারণেই অনন্য, অসাধারণ এবং চোখ খুলে দেওয়ার মতো একটি জাদুর কাঠি। যে যার সাধনে থাকে সে তার মতো করে সফলতার সংজ্ঞা দিবে-এটাই স্বাভাবিক। এখানে দেখলাম যে মানুষ যদি সফল হতে চায় তবে তাকে অবশ্যই সাধু ও মহৎগণের মতো মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আমরা সফলতা চাই কি না -জানি না তবে আমরা রোজ নিয়ত করি বদলে যাবো, আমরা বদলে যেতে চাই।

আমাদের বাংলাদেশের সেরা একটা শ্লোগান, বদলে যাও, বদলেও দাও অথচ এ সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেন, উন্নতি করতে চাইলে বদলাতে হবে। আর সেরা হতে চাইলে নিয়মিত বদলাতে হবে। হ্যাঁ, আমরা বদলে যেতে না চাইলেও সেরা হতে চাই আর আমাদের সেরার সূত্র ও প্রতিযোগিতা তৈরি হয় আমার ক্লাস থেকে। আমরা প্রথমে এক রোল হতে চাই, তারপর সকল পরীক্ষায় গোল্ডেন প্লাস পেতে চাই। তারপর শুরু হয় আমাদের ভর্তি যুদ্ধ কারণ এ যুদ্ধে জয়ী হলে আমরা হবো দেশ সেরা কোনো না কোনো ভার্সিটির স্টুডেন্ট!

আমরা সেরা হই, আমাদের পিতামাতা গর্বিত হয়, আমাদের গুরুজনসহ নানাবিধ কোচিং সেন্টার সেরা হওয়ার বিজ্ঞাপনে নেমে পড়ে। ছোট্ট বেলা থেকে আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাক্রম সবকিছু আবর্তিত হয় শুধু ছাত্র সেরা হওয়ার ব্যাপারে, শিক্ষাজীবনে সফল হওয়ার ব্যাপারে। ছাত্র জীবন শেষ, ব্যস, আমরা নেমে পড়ি বাংলাদেশের নোবেল জয় (বিসিএস) করার অভিপ্রায়ে। সে কী যুদ্ধ! পঁচিশ বছর পড়ালেখা করে আবারও চলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার মহা সংগ্রাম।

একজন বিসিএস ক্যাডার হলে তিনি হোন সেরা সফল এবং তাঁর জন্য সকল দুয়ার খোলা। বিয়ে সাদিতে আকাশচুম্বী চাহিদা বাড়ে এবং তাঁর আর কোনো পরিচয় প্রয়োজন হয় না। আমার মনে হয় আমরা বাংলাদেশিরা কেন চিকিৎসা, অর্থনীতি, রসায়নে, পদার্থে, সাহিত্যে ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার কেন পাচ্ছি না। আমরা আসলে বিসিএস পর্যন্ত জীবনের টার্গেট করে ফেলেছি এবং এটাই আমাদের সেরা অর্জনের ভেতর সেরা। অথচ, আমাদের এই বিসিএস ক্যাডাররা আরও চেষ্টা করলে বিশ্বের দামী কোনো গবেষক, চিকিৎসক, সাহিত্যিক হতে পারতেন কিন্তু হতে চাননি; সফলতা তাঁদের দ্বারে এসে থেমে গেছে।

এই যে কথাগুলো বললাম তাতে আমরা কোথাও খুঁজে পেলাম না যে আমরা মানুষ হবো, মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সেরা হতে হবে। মনুষ্যত্বের চর্চা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতিতে নেই বললেই চলে। এখানে কেবল এগিয়ে যাওয়ার মনোবাসনা আছে। দিনে দিনে জনসংখ্যা বাড়ছে, মানুষ নয় কারণ মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতার সকল দরজা স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ। আর এ কারণেই বুঝি লালন বলেন, মানুষ লুকালো কোনো শহরে/সারা জগৎ মানুষ খুঁজি পাই না তারে/তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক গানে আরও বলেন,/মানুষ মানুষ সবাই বলে/আছে কোন মানুষের বসত, কোন দলে। আমাদের দায়িত্ব, আমাদের বক্তব্য হয়ে গেছে নিজ নিজ পেশাভিত্তিক। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে সদা বলেন, পড়াশোনা করো, জীবন গড়ো। না পড়লে কী করবে জীবনে। আমরা কেউ বলছি না আসল সফলতা কেথায়? আমরা মানুষ হবো, আমরা শালীন চিন্তা করবো। অর্থ, শিক্ষা এসবই জীবনের সফলতা নয়।

সফলতার প্রকৃত সংজ্ঞা আসছে পবিত্র কোরআনের ১০৩ নং সূরা আল -আসর যা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তিন আয়াতের ছোট্ট এ সূরার অর্থ এ রকম, ‘‘সময়ের কসম। মানুষ অবশ্যই বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তবে তাঁরা ছাড়া যাঁরা ঈমান এনেছে ও সৎ কর্ম করেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথার ও সবর করার উপদেশ দিয়েছে। অর্থাৎ যাঁরা মহান প্রভূর উপরে ঈমান এনে শুধু ক্ষান্ত হয়নি বরং ভালো কাজ করেছে, হক কথা বলেছে এবং জীবনের কঠিন সময়ে সবর বা ধৈর্য ধারণ করেছে -এঁরাই প্রকৃত প্রস্তাবে সফল।

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন তা হলো সফলতার জন্য সকল ধর্মগ্রন্থ, সাধু বা মহাজ্ঞানীরা কী বলে গেলেন আর কী করলেন আমরা তা অনুসরণ না করে বরং বাস্তব ও বস্তুগত জীবনে ক্ষণিক লাভবান হওয়ার জন্য সফলতার আধুনিক সংজ্ঞা বের করেছি, প্রচার করছি এবং আমাদের নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করছি। আমার মনে হয় বলন কাঁইজি যেমন বাংলার প্রতিটি বর্ণ দিয়ে মানব জীবনের সফলতা ও সতর্কতা প্রকাশ করেছেন তেমনি আমরা যদি ৪০/৫০/৬০ বা তারও বেশি বছর বাঁচি তাহলে এই সংখ্যাগুলো একত্রে করে আমাদের জীবনকেও একটা সার্থক কাব্যে প্রকাশ করতে পারবো, শুধু চিন্তার ব্যাপার, ধৈর্যের ব্যাপার আর গতানুগতিক শিক্ষা ও সফলতার সংজ্ঞা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। শিক্ষা, চাকরির অদম্য প্রতিযোগিতা আমাদের মানুষ পরিচয় ভুলে দিয়েছে; আমরা মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই, আমরা মানুষ হয়ে একে অপরের পাশে থাকতে চাই।

আমরা কেমন সফল হচ্ছি যেখানে পিতামাতা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে, যেখানে এক ফ্ল্যাটে কেউ মরে থাকলে অপর ফ্ল্যাটের কেউ জানে না। আমরা কেমন সফল হচ্ছি যেখানে শিষ্যের হাতে গুরু অপমানিত হচ্ছে।ুু এ সফলতা আমরা চাই না।

আমরা মানুষ হিসেবে সফল হলে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আজ দুর্বৃত্তায়ন হতো না; স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসনের মধ্যে থেকে আমরা হতে পারি অনুসরণীয় জাতি। শেষ করবো লালন শাহ এর একটি গানের লাইন দিয়ে, মানুষ অবিশ্বাসে/পাই না সে মানুষ নিধি/এ মানুষে মিলত মানুষ রতন/চিনিতাম যদি...।

 

লেখক : শিক্ষক

01641-806804



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS