ভিডিও

চোরাই চিনিতে চরম দুর্দিনে দেশীয় চিনি শিল্প

আব্দুল হাই রঞ্জু

প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৪, ০৬:২২ বিকাল
আপডেট: মে ২৬, ২০২৪, ০৬:২২ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ক্রমবর্ধমান বৃহৎজনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মধ্যে চিনি অন্যতম। প্রতিটি বসতবাড়ী, হোটেল, রেস্তোরা, ছোট-বড় চায়ের দোকানে দৈনন্দিন চিনির চাহিদা প্রচুর। সূত্র মতে, বাংলাদেশে বছরে ২২ থেকে ২৩ লাখ টন চিনির চাহিদা।

যার সিংহভাগ দেশের রাষ্ট্রায়াত্ব ১৫টি চিনি কলে উৎপাদন করা সম্ভব হলেও স্বাধীনতাত্তর ক্ষমতাসীনদের দুর্বলতা, অদুর্দশিতা, অবহেলা, উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব এবং দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে একে একে প্রায় সবগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

ফলে ভোক্তার চাহিদা পুরণে সরকার বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানির সুযোগ দিয়ে দেশে রিফাইন করে বাজারজাত করণের পথেই হাঁটতে শুরু করে। সে সুবাদে দেশের অভ্যন্তরেই ৭-৮টি শিল্প গ্রুপ প্রতি বছর হাজার হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধনের প্রয়োজনে দেশে রিফাইনারী চিনি শিল্প স্থাপন করে। অথচ আমাদের দেশটি মূলত কৃষিনির্ভর।

কৃষিই আমাদের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। যে দেশে ধান, পাট, কালাই, সরিষা ও আঁখের প্রচুর চাষাবাদ হচ্ছে। এখন স্বাধীনতা উত্তর সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যা ১৭ কোটিতে রুপান্তর হলেও একমাত্র কৃষি খাতের সমৃদ্ধিকে ঘিরে খাদ্য নিরাপত্তাা নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সম্ভব হয়েছে। নদী-নালা, খাল-বিলে ভরা অপার সম্ভাবনার দেশটি শুধু ক্ষমতাসীনদের অপরিনাম দুরদর্শিতার অভাবে বিদেশীদের বাজারে পরিণত হচ্ছে।

প্রাসঙ্গিকতার খাতিরেই কিছু কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি। দেশে এখন ছোট নদীগুলো মরা খালে পরিণত হয়েছে। খাল-বিল বলতে তেমন কিছুই নেই। আর ছোট-বড় সকল নদী শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পরিণামে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল চরের। দীর্ঘদিন এসব চরে বন্যার সময় পলি মাটি পড়ে আবাদযোগ্য হওয়ায় এখন ধান, পাট, কালাই, সরিষা, ভুট্টা ও শাক সবজির ব্যাপক চাষাবাদ হচ্ছে। অথচ এসব জমিতে প্রচুর পরিমাণ আঁখ চাষের সম্ভাবনা থাকলেও এখন আর তেমন আঁখ চাষ হয় না।

যদিও কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল আঁখের উদ্ভাবন হয়েছে। যেখানে প্রচুর পরিমাণ আঁখ চাষ করে শুধু ১৫টি রাষ্ট্রায়াত্ব চিনিকলেই নয় বরং আরো চিনিকল স্থাপন করলে দেশে উৎপাদিত আঁখ দিয়েই পুরো মৌসুম চিনিকলগুলো চালু রাখা সম্ভব ছিল।

অথচ স্বাধীনতাত্তর কোন সরকারই সে পথে হাঁটেনি। ফলে কৃষিনির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষিভিত্তিক বৃহৎ কোন সরকারি-বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। অথচ মানুষের খাদ্য চাহিদা পুরণে জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে হাতেগুনা ক’টি কর্পোরেট গ্রুপকে সুযোগ করে দেয়ায় চিনির একচেটিয়া আধিপত্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

যারা সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর ধরে ভোক্তার গলা কাটছে। সেখানেও বিপত্তি! দেশে চিনিকল মালিকদের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দাম নেয়ায় দেশীয় চিনির বাজার দখল করে নিয়েছে ভারতীয় চোরাই চিনি। অনেকটা ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার ন্যায়’ এখন ভারতীয় চিনি দেশীয় রিফাইনারি চিনিশিল্পের উপর জগদ্দল পাখরের মতো জেঁকে বসেছে।

ভারতীয় চোরাই চিনিতে সয়লার দেশের বাজার। এতে ধ্বংসের মুখে পড়েছে বেসরকারি খাতের চিনি পরিশোধনাগারগুলো। ছয় লাখ টন অবিক্রিত চিনির মজুদ আটকে গেছে পাঁচটি সুগার রিফাইনারির গুদামে। এতে একদিকে চিনির উৎপাদন কমেছে, অন্যদিকে ঋণের বোঝাও বাড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। কেনো এত চিনির মজুদ? কি কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেশিয় রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলো? কারণ একটাই, তাহলো ভারতীয় চোরাই চিনিতে দেশের বাজার এখন সয়লাব।

হাত বাড়ালেই বস্তার পর বস্তা মিলছে ভারতীয় চোরাই চিনি। এ প্রসঙ্গে মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার আবু বাকর জানান, বিশেষ করে গত রোজার মাসে আমাদের এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন চিনি বিক্রির সম্ভাবনা ছিল, সেখানে ওই মাসে চিনি বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার মেট্রিক টন। তিনি আরো বলেন, ভারতীয় চোরাই চিনির কারণে বাজারে এখন দেশীয় চিনির বিক্রি আশংকাজনকভাবে কমে গেছে।

ফলে বিভিন্ন মিলের গুদামে বিপুল পরিমাণ চিনি ও চিনি উৎপাদনের কাঁচামাল পড়ে রয়েছে। এতে একদিকে দেশিয় চিনি শিল্পে যেমন ঋণের বোঝা বাড়ছে, তেমনি সরকারও রাজস্ব হারিয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, চিনি রিফাইনারি শিল্পের এই ক্লান্তিকালে ৮ হাজার কোটি টাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিনি চোরাচালান বন্ধ করে এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা আবেদন জানিয়েছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সুগার অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টনের মতো।

যা দিয়ে দেশের চিনির মোট চাহিদার প্রায় ৯৯ শতাংশ যোগান দেয়া হচ্ছে। অথচ ভারতীয় চোরাই চিনির কারণে আজ দেশিয় চিনি শিল্পে চরম দুর্দিন চলছে। অথচ ভারতীয় চিনির চোরাই বন্ধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপকভাবে তৎপরতা অব্যাহত রাখার পরও চিনি চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। গত ৪ মে নারায়নগঞ্জের তারার পৌরসভা এলাকা থেকে ৬২৪ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করেছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

উদ্ধার করা এসব চিনির ১৪৪ বস্তা ছিল মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ব্রান্ডের মোড়কে, বাকি ৪৮০ বস্তা ছিল ভারতীয় ব্রান্ডের মোড়কে। এরপর গত ১৩ মে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে উদ্ধার করা হয় ১ হাজার ২৯২ বস্তা ভারতীয় চিনি। এ ভাবে দু-এক দিন পরপর সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে ভারতীয় চিনি।

চোরাকারবারিদের আনা ভারতীয় চিনি দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মোড়কে বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসা হারাচ্ছেন ভোগ্যপণ্যের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা। চিনির আমদানিকারক ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারী সময়ে দেশে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৫ মেট্রিক টন।

অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৯ মেট্রিক টন। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের উল্লেখিত ৩ মাসে কম আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৬৫ মেট্রিক টন। ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দেয়ার কারণে সুযোগ নিচ্ছে চোরাকারবারীরা। কারণ দেশের ভোক্তার চাহিদা তো আর দমিয়ে রাখা যাবে না। যা পুরণে ভারতীয় চিনি দেদার পাচার হয়ে দেশে ঢুকবে, এটাই স্বাভাবিক।

ফলে চোরাই পথে চিনির বড় একটি অংশ আসছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর সহ সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। এ বিষয়ে সিলেট বাংলাদেশ পুলিশ রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান সাফিউর রহমান বলেন- চোরাচালান বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি। আবার চিনি চোরাইকারবারীদের তালিকা করে যাচাই বাছাই শুরু করেছি। আশা করছি, দ্রুত চোরাই পথে চিনি ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, চোরাকারবারী রোধে সীমান্তে দায়িত্বরত বিজেবি সদস্যরা রয়েছেন। আর ভিতরে আছে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়োজিত সদস্যরা। এরপরও সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে দেশে ঢুকছে হাজার হাজার টন চিনি। এটা কিভাবে সম্ভব? তাহলে কি জনগণ ভেবেই নিবেন, সঠিক ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে না।

কথায় আছে, জেগে ঘুমানো মানুষকে যেমন জেগে তোলা কঠিন, তেমনি দায়সারা গোছের চোরাই চিনি জব্দ করে যদি বলা হয় চোরাকারবারীদের ধরতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট তৎপরতা রয়েছে। আর যাই হোক, এটাকে বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের ধরতে অপারগ, এটা দেশের আমজনতা বিশ্বাস করবে কেমন করে? কারণ বাঘা বাঘা অপরাধি, জঙ্গি দমনে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট কৃতিত্ব রয়েছে, সেখানে নির্দিষ্ট কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার টন ভারতীয় চিনি দেশে ঢোকা বন্ধ করা কি অসম্ভব?

আমরা মনে করি, দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে চিনি চোরাই যে কোন মূল্যে রোধ করতে হবে। তা না হলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা যেমন তাদের ব্যবসা হারাবেন, তেমনি দেশও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। ভারতে এক কেজি চিনির দাম মাত্র ৪০ রুপি। সেখানে ওই চিনি দেশের বাজারে বিক্রি হওয়ার কথা ৫৬ থেকে ৬০ টাকায়।

অথচ নিম্নমানের ভারতীয় চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকায়। অর্থাৎ প্রায় সমপরিমাণ মুনাফা! এও কি সম্ভব? কিন্তু বাস্তবে যা অসম্ভব মনে হচ্ছে, তাই আমাদের দেশে সম্ভব হচ্ছে। আর চোরাকারবারীরা বিপুল অংকের মুনাফার এই অর্থের অংশবিশেষ যদি বিভিন্নখাতে ব্যয় করে, আর তারা যদি সে সুযোগ নেন তাহলে চোরা চালান বন্ধ হবে কি করে?

পরিশেষে শুধু এটুকুই বলতে চাই, অনেক আগেই রাষ্ট্রায়াত্ব চিনি শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। জনস্বার্থে রাষ্ট্রায়াত্ব চিনি শিল্পকে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন। তাহলে একদিকে যেমন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে কৃষি নির্ভর দেশে পুনরায় আঁখ চাষীদের আঁখ চাষ শুরু হবে। আর আমাদের দেশের চিনি অন্য যে কোন দেশের চিনির চেয়ে উন্নতমানের।

ফলে দেশের মানুষও সহনীয় মূল্যে উন্নতমানের চিনি খেতে পারবে। স্মরণে রাখতে হবে, সাধারণ ভোক্তার চাহিদা পুরণে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের বিকল্প বিদেশী পণ্যের ব্যবহার কোনভাবেই দেশের কল্যাণে কাজ করবে না। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে যতদ্রুত সম্ভব দেশে ভারতীয় চিনির আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে।

পাশাপাশি দেশের সমৃদ্ধ অর্থনীতির স্বার্থে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষায় সরকারকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প আমাদের সামনে খোলা নেই।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS