ভিডিও

ধর্ষণ পরিণত হয়েছে সামাজিক ব্যাধিতে

হুমাইরা খানম জেরীন

প্রকাশিত: জুন ০৫, ২০২৪, ০৭:৩৪ বিকাল
আপডেট: জুন ০৫, ২০২৪, ০৭:৩৪ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ধর্ষণ বর্তমান সমাজের একটি অতি জঘন্যতম এবং ঘৃণ্যতম অপরাধ। যা বিগত কয়েক দশকের মধ্যে একটি মহামারির রূপ ধারণ করেছে। আর ধর্ষণের থাবা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না ৩ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও। বিগত কয়েক দশক আগে ধর্ষণ ছিল একটি আচমকা ঘটনা। কিন্তু সম্প্রতি এটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পত্রিকা এবং বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের তথ্য মতে দেশে ২০১৮ সালে শিশু ধর্ষণের মামলা ছিল ২৭টি এবং নারী ধর্ষণের মামলা ছিল ৩ হাজার ৯০০টি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ২০০৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতি মাসে গড়ে ৮৪ টি শিশুর ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর তথ্যানুসারে ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ধর্ষণের শিকার ২ হাজার ৫২৯ জন এবং ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ৫ হাজার ৯২৭ জন, ধর্ষণ পরবর্তী খুন ১ হাজার ৪৬৭ এবং ধর্ষণ পরবর্তী আত্মহত্যা ১৫৪ জন।

প্রতিনিয়ত ধর্ষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। চারপাশে ধর্ষণের এই ছোবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু, কিশোরী, তরুণী, স্কুল পড়ুয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী এমনকি ৮০ বছরের বৃদ্ধাও। সমাজে মানুষরূপে বসবাস করা জানোয়ারগুলো নির্দ্বিধায় করে যাচ্ছে ধর্ষণের মতো অপরাধ। শিশু এবং নারী কোথাও নিরাপদ নয়। আর নিত্যদিনের এই ধর্ষণ চারপাশের পরিবেশে সৃষ্টি করছে অস্থিরতা, থমকে দিচ্ছে হাজারও মেয়ের পড়ালেখা আর নিঃশেষ করে দিচ্ছে নারীর সুন্দর জীবন ও স্বপ্নকে।

প্রতিবছর ধর্ষণের হার বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। নারীদের প্রতি সংকীর্ণ ও নেতিবাচক মনোভাব। সাধারণত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা নারীকে দুর্বল ও সামাজিক অধিকারহীন মনে করে। তারা সমাজে শিক্ষাক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্র সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর বিচরণকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, একজন নারীর কর্ম, শিক্ষাক্ষেত্রে পদচারণকে তারা অশালীন হিসেবে ধরে নেয়।

ফলে নারীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তারা তাদের মস্তিষ্কে ধারণ করে এবং পরবর্তীতে নারীদের প্রতি অযাচিত ও অশালীন আচরণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। সর্বোপরি এর ফলাফল হিসেবে একপর্যায়ে নারী ধর্ষিত হয়। আবার ধর্ষণকে এখন প্রায় সাধারণ অপরাধ হিসেবেই গ্রহণ করা হয়। একটা সময় মানুষ ভাবতো এই অপরাধ অতি জঘন্য এবং এই ধরনের অপরাধ করতেও ভয় পেতো। কিন্তু বর্তমানে ধর্ষণের হার এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া যেন গণমাধ্যম অসম্পূর্ণ।

তাই অপরাধী এখন ধর্ষণের মতো অপরাধকে সহজভাবে নিয়েছে এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। ধর্ষণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হিসেবে মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করা যায়। প্রযুক্তির অগ্রগতি যতই বাড়ছে, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে মানুষ বেশি আসক্ত হওয়ার দরুণ মানুষের থেকে লোপ পাচ্ছে সামাজিকতা, নৈতিকতা ও চেতনাবোধ।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে বাবা মেয়েকে ধর্ষণ, শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ, এমন চিত্রও আমাদের দেখতে হয়! আবার ধর্ষণের মামলায় প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রিতাও একটি কারণ। বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষ বলছে, তারা এক গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলায় ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করেছে।

এ গবেষাণাটির পরিচালক এবং নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা বলেন, এই সময়ে ৪৩৭২টি ধর্ষণের মামলা হারাচ্ছে, কিন্তু সাজা হয়েছে মাত্র পাঁচ জনের। এ থেকে বুঝা যায় যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে মামলা ও বিচার প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ। বর্তমানে ইন্টারনেট যতটুকু মানবকল্যাণে বয়ে এনেছে ততটুকুই অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুবসমাজের জন্য। নাটক, সিনেমার বিভিন্ন নেতিবাচক দিকের প্রতি আসক্তি এবং পর্নোগ্রাফি হাতের নাগালে হওয়ার ফলে ধর্ষণের প্রতি ঝুঁকি বাড়ছে তরুণ প্রজন্মের।

উল্লিখিত কারণগুলো ধর্ষণের মতো সমাজে তার জাল বিস্তার করতে অন্যতম ভূমিকা রাখছে। সমাজে করছে কলুষিত এবং বিরাজ করছে নৈরাজ্য, অরাজকতা। দেশে কন্যা শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নে আছেন অভিভাবকরা। অনবরত নারী অপহরণ, ধর্ষণ হাপিয়ে উঠছে দেশ। দেশকে ধর্ষণের থাবা থেকে মুক্ত করতে কয়েকটি বিষয় আমাদের নজর দেওয়া উচিত। কয়েকটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমরা স্বল্প সময়ে এই অপরাধের কবল থেকে দেশ ও সমাজ রক্ষা করতে পারবো।

প্রথমেই ধর্ষণের মামলায় প্রশাসনকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ ও তদন্ত করতে হবে। অপরাধীকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক আশ্রয় অবলম্বন করে ছাড় দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আইনের শাসনই মুখ্য। তাই ধর্ষণকারীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যেটি বর্তমানে নেই বললেই চলে।

আইনানুযায়ী অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে। কারণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাসহ অর্থদন্ড, যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ও মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকলেও খুব কম ধর্ষকদের শাস্তি দেওয়া হয়। এছাড়াও ধর্ষণের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ বিস্তৃতকরণ। এই সমাজ নারী ও পুরুষ উভয়ের। নারীর সাথে অন্যায় হলে অবশ্যই প্রথম নারীকে প্রতিবাদে সচেষ্ট হতে হবে।

নারীকে নিজ অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হবে। আমাদের দেশে ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকেই আড়চোখে দেখা হয়। যার ফলে ধর্ষিতার পরিবার নিজেরাই বিষয়টা গোপন রাখে। সেই কারণে জরিপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ধর্ষণের ৫০ শতাংশই মামলা করা হয় না। এর ফলস্বরূপ নারীর অধিকার লুণ্ঠিত হয় এবং নারী প্রাপ্য বিচার পায় না।

ধর্ষণ বন্ধে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রসারে কার করতে হবে।  তাই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার চর্চা করতে ধর্মীয় অনুশাসন, শিষ্টাচার অনুসরণ করলে মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ হবে এবং সর্বোপরি সমাজে অপরাধ প্রবণতা ও অপরাধ দুটিই দূর হবে। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করতে হবে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে সমাজের ভোগ্যবস্তু মনে করা হয়। নারীর উপর অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন, অবিচার করতে সংকোচ করে না। সর্বোপরি প্রযুক্তির ব্যবহারে সতর্কতা থাকা। সর্বসাধারণকে প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক গ্রহণ করে মানবকল্যাণে কাজ করার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।


লেখক : শিক্ষার্থী, অনার্স ২য় বর্ষ
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ
চকবাজার, চট্টগ্রাম

01601-812682



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS