ভিডিও

পরম সহিষ্ণুতায় দায়িত্ব পালনকারীর নামই বাবা

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৪, ০৬:৪৭ বিকাল
আপডেট: জুন ২৪, ২০২৪, ০৬:৪৭ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বাবার জন্য যে সংজ্ঞাই দেওয়া হোক তা মনে হয় বাবাকে পরিষ্কার করে বুঝতে অক্ষম। বাবা এমনই শব্দ যা শুধুই অনুভবের ও হৃদয়াঙ্গমের বিষয়। বুঝিয়ে প্রকাশের নয়। একজন বাবা ছাড়া কেহই বুঝবে না বাবার হৃদয়টা সন্তানের মঙ্গল আর ভালোবাসায় কতটা প্রসারিত আর কত গভীরে গ্রথিত। সন্তানের যেকোন আবদার কত আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে বাবা পূরণ করেন তা শুধুমাত্র বাবার পক্ষেই জানা সম্ভব।

রাগ রাসভারী চেহারার আড়ালে যে অতি সুকোমল বিস্তীর্ণ পরম হৃদয় রয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। কিসে সন্তানের মঙ্গল কিসে সন্তানের ভবিষ্যত, কিভাবে সন্তানের সামগ্রিক উন্নতি সবকিছুই বাবার চিন্তা। সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে উন্নতির শীর্ষে সন্তানকে পৌঁছে দেওয়া বাবার ব্রত। এই পবিত্র ব্রতকে পালন করতে গিয়ে বাবা নামক মানুষটি নীরবে নিভৃতে যে কত চেষ্টা করে তা হয়তোবা ওই মুহূর্তে সন্তানরা জানেনা।

অনেক বাবা আছেন যাঁরা ছেলে মেয়ের আবদার পুরণ করতে গিয়ে নিজের চাকরির ডিউটি শেষ করে অতিরিক্ত দায়িত্ব বা অন্য চাকরি করে থাকেন। নিজের দিকে না তাকিয়ে নিজের শরীর ও পোশাক পরিচ্ছদের কথা চিন্তা না করে নিজের সাধ আহলাদকে বিসর্জন দিয়ে যে মানুষটি একমাত্র সন্তানের চিন্তায় মগ্ন, সন্তানের মঙ্গল আরাধ্যে নিমজ্জিত তিনিই হলেন পিতা। তিনিই খেজুর বৃক্ষের মত।

যার শরীর কেটে ক্ষত বিক্ষত করে রস বের করে সন্তানেরা সুমিষ্টি উপভোগ করে কিন্তু খেজুর গাছ তা অতি নীরবেই সহ্য করে মানুষ নামক ছেলে মেয়েদের সন্তুষ্টিতে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। একই ভাবে শত ব্যথা বেদনা, বিষাদ আর নির্মমতা সহ্য করে বাবা সন্তানের হাসিমাখা মুখটিতেই চরম আত্মতুষ্টি লাভ করেন। নিমিষেই ভুলে যান তাঁর সকল কষ্টের কথা। বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা সবার মধ্যেই থাকে। বাবা এমন এক সত্ত্বা যা সন্তানের বড় হওয়ার জন্য নিজে ছোট হতে সামান্যতম কুন্ঠা বোধ করেন না। বরং গর্ববোধ করেন।

বাবা যখন তার ছেলে বা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন তখন যে স্বর্গীয় সুখানুভতি অনুভব করেন তা বাবা ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। আমি নিজেও বাবা হওয়ার পূর্বে এ অনুভুতি উপলব্ধি করি নাই। বাবার অপর নাম আবদার পূরণের ভান্ডার। পথ নির্দেশনার বাতিঘর, আর নীরবে দায়িত্ব পালনের এক মহৎপ্রাণ সত্ত্বা। একজন সন্তানের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর, এত রঙ্গিন, এত সবুজ এত আনন্দের হওয়ার পিছনে যে মহান মানুষটির আকুতি আর শ্রম মিশে আছে তিনিই হলেন জন্মদাতা পিতা।

যাঁর অনুপস্থিতিতে সারা পৃথিবী ধুসরময়, অসহ্য যন্ত্রণার আস্তাঘর। সূর্যের তাপ কত প্রখর ও সর্বগ্রাসী তা বাবার অনুপস্থিতিতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। ঝড়ের গতিবেগ কত এবং তা কত বেগে আঘাত হানতে পারে এবং সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে তাও বুঝা যায়। বাবা নামক বিশাল ও শক্তিশালী বটবৃক্ষটি না থাকলে। চরম বিপদে দুনিয়ার সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও যিনি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সন্তানের পাশে থাকেন তিনিই হলেন বাবা।

সন্তান ছোট বেলায় কোন কিছু জানার জন্য অনুসিন্ধ্যৎসু মন নিয়ে বাবাকে যতবারই কোন কিছু জিজ্ঞেস করুক না কেন, বাবা অত্যন্ত আগ্রহ ও ভালোলাগার অনুভূতি নিয়ে সঠিক উওরটি তাঁর প্রিয় সন্তানকে স্বাচ্ছন্দ্যে দেন।

সন্তান ধারণে মা যেমন অনেক কষ্ট করেন বাবারা সেই কষ্ট লাঘব করার জন্য সমানতালে মায়ের পাশে থেকে স্ত্রী ও সন্তানের যত্ন নেন। স্ত্রীর কষ্টে সমব্যথিত হন। মা সন্তান জন্মদানে যে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেন বাবা তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করেন। তাইতো বাবারা ওই সময়টা মায়েদের ছেড়ে কোথাও যেতে চান না। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর বাবার দায়িত্ব দ্বিগুণ হয়ে যায়। কিন্তু সাহস আর উদ্দীপনা দ্বিগুণও হয়ে যায়। পৃথিবীর বলয় গড়ে উঠে ঔরসজাত সন্তানকে কেন্দ্র করে। 


সন্তানের বেড়ে উঠার সাথে সাথে বাবার স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার সম্প্রসারণ হতে থাকে। আর সন্তানের কাছে বাবা হয়ে উঠেন সুপার হিরো। সন্তানের বেড়ে উঠা স্কুলিং, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাবার নীরব বা সরব উপস্থিতি। ছেলে মেয়ে এবং প্রিয় সংসারের সকল প্রয়োজনীয়তা মিটিয়ে নিজের খোঁজ খবর নেওয়ার খুব একটা সময় বাবারা পান না।

সংসার নামক গুরুদায়িত্বের একমাত্র কান্ডারী যার খেয়াল সবখানে। সকল উৎসবে সন্তান আর স্ত্রীর মুখের হাসিই হয়ে তাঁর জীবনের একমাত্র পাওয়া। নীরবে চিন্তা করেন কোন কোন আকাক্সক্ষা আর প্রয়োজনীয়তা বাচ্চাদের অপূর্ণ আছে এবং তা কিভাবে পূরণ করা যায়। দেশে উচ্চ শিক্ষা শেষ করে বাচ্চাদের উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে এই নিরীহ প্রাণ মহান মানুষটি মরিয়া।

এতকিছু শেষ করার পর ছন্দপতন ঘটে শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো যখন তার আগের মত কাজ করে না। অবহেলা আর বৈষম্যের শিকার হন তখন থেকে যখন প্রিয় সন্তানটি তার নিজ সংসারে প্রবেশ করে। অবজ্ঞা আর অবহেলার পাত্রে পরিণত করে বিশালাকার এই বৃক্ষটিকে। নচিকেতার গানের তখনই সুর ভেসে আসে, যখন সুপার হিরো পরিণত হয় অবজ্ঞার পাত্রে।

স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয় যখন বাড়িতে অ্যালসৈসিয়ান দখল করে নেয় এক সময়ের সকল ভরসার স্থল হিসাবে চিহ্নিত বাবার থাকার ঘরটাকে। আর বাবা নামক নিরীহ প্রাণিটি তখন থেকেই ভাবতে শুরু করেন খোকার ছায়াও তো বড় হতে শুরু করেছে। বাবার স্থান যখন অন্যের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে বাবার অবস্থান বৃদ্ধাশ্রমে তখন বাবাও তো স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা করবেন খোকারও তো বয়স হয়েছে।

তারও তো ছেলে আছে, আর বৃদ্ধাশ্রমের রুমও বড় আছে। বাস্তবতা অনেক নির্মম হয়েছে। এই নির্মমতা যেন সবাইকে গ্রাস করতে না পারে তাইতো আমেরিকার ফেয়ারমন্ট ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়া  ৫ জুন ১৯০৮ সাল হতে শুরু হয়ে জুন মাসের ৩য় রবিবারে বাবা দিবস উদযাপন হয়ে আসছে।

মায়ের মত পৃথিবীর সকল বাবাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এই আয়োজন। এক পরিসংখানে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রবীণদের মধ্যে শতকরা ৮৮ ভাগেরই একজন বা একাধিক সন্তান দেশের বাইরে থাকে।

তাদের সাথে তাদের পিতা-মাতার যোগাযোগ খুব একটা ঘটে না। বৃদ্ধ বয়সে তাঁরা অত্যন্ত আর্থ সামাজিক কষ্টেই দিনাতিপাত করছেন। এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। অর্থাৎ ছেলে মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করতে গিয়ে নিজের যথাসাধ্য সবকিছু খুইয়ে বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের আশ্রয় হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। বাবা নামক পবিত্র সম্পর্ক কলুষিত হচ্ছে।

দেশে বাবা মার সাথে থেকেও বাবা মাকে আলাদা করে দিয়েছে শুধুমাত্র পার্থিব কিছু লোভের কারণে। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের সূরা আল বনি ইসরাইলের ২৪নং আয়াত সূরা নিসার ৩৬নং আয়াত, সূরা লোকমানের ১৪নং আয়াতে আল্লাহ পাক পিতামাতার খেদমত করার নির্দেশ দিয়েছেন। সন্তানের জন্য পিতার দোয়া আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে কোন আড়াল থাকে না।

পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহী পরমং তপ: পিতরী প্রিতিমাপন্নে সর্বদেবতা' সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই মন্ত্র জপে পিতাকে স্বর্গ জ্ঞান করে শ্রদ্ধা করেন। জন্মদাতা পিতা যার জন্য এই পৃথিবীর মুৃখ দেখা যার জন্য বড় হয়ে ওঠা, যার জন্য আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমি ওমুক, আমি তমুক, সেই মহান মানুষটির প্রতি কিভাবে অবহেলা করি।

আমি কিভাবে অতীতকে বেমালুম ভুলে রঙ্গিন ভবিষ্যৎ গড়তে চাই। এটা কশ্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই আসুন বাবা দিবসেই শুধু নয় প্রতিটি মুহূর্তেই এই মহৎপ্রাণ মানুষটির প্রতি যথাযথ মর্যাদা ভক্তি-শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর হৃদয় নিংড়ানো সম্মান প্রদর্শন করে সেবা করার মাধ্যমে নিজেকে ধন্য করি।


লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS