ভিডিও

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতা

মোহাম্মদ নজাবত আলী

প্রকাশিত: জুন ২৫, ২০২৪, ০৬:৩২ বিকাল
আপডেট: জুন ২৫, ২০২৪, ০৬:৩২ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। এ জন্য শিক্ষাকে জাতির মেরুদন্ড বলা হয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, শিক্ষা জাতির মেরুদন্ডের চেয়েও বেশি কিছু।

কারণ মেরুদন্ডহীন প্রাণী (যেমন কেঁচো) চলতে পারেনা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারেনা। কিন্তু শিক্ষা ? শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি চলতে পারে না। এ চলা মানেই জাতির অগ্রগতি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি। কিন্তু অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকরা কেমন আছেন?

বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। এ পেশার সঙ্গে যারা জড়িত তারা শিক্ষক। আবার পেশার দিক থেকে বলা হয় শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। জীবন জীবিকা নির্বাহের জন্য যত পেশা রয়েছে তন্মধ্যে শিক্ষকতা শ্রেষ্ঠ। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, সবশ্রেষ্ঠ মহান পেশা এ শব্দগুলো খুবই সম্মানজনক। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

সময়ের চাহিদা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশও শিক্ষায় পিছিয়ে নেই। একটি দক্ষ জনগোষ্ঠী ও আলোকিত সমাজ গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাই শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না।

বিশ্বে যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। কেননা একটি জাতির উন্নতির প্রথম সোপানই হচ্ছে শিক্ষা। আর এর সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তারাই শিক্ষক হিসাবে সমাজে সুপরিচিত। তাই বলা অযৌক্তিক হবে না যে, শিক্ষার সাথে শিক্ষকের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবির।

একটিকে বাদ দিলে আরেকটি চলতে পারে না। তাই শুধু দেশের উন্নয়নই নয় একটি মেধা ভিত্তিক সমাজ গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ পেশায় যারা জড়িত তারা অত্যন্ত কষ্ট করে নিজের মেধা, কলা কৌশল প্রয়োগ করেন শ্রেণি কক্ষে। যাতে করে প্রিয় শিক্ষার্থীরা শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে উঠে।

একজন শিক্ষক তার অন্তরের সব কিছু উজাড় করে দেন শিক্ষার্থীর মাঝে। দেশের শিক্ষক সমাজ এমন একটি পেশা বা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি দেশ, সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর এ প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে শিক্ষা দান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটিয়ে শিক্ষার্থীকে মানবিক করে তোলে। একটি পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলে।

একজন শিক্ষক শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ও সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলায় শিক্ষার উন্নতম লক্ষ্য। যা অর্জনের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ প্রকৃত খাঁটি মানুষে পরিণত হয়। একজন মানুষ মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়ে তার মনের কুপ্রবৃত্তিগুলো

দূরীভূত করে সত্য ও ন্যায়বোধ জাগ্রত করে। আলো, হাওয়া স্বাদ বঞ্চিত মানুষগুলোকে একজন শিক্ষক মানবিক মূল্যবোধ অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। কাজেই প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ একটি দেশের সম্পদ। তাই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী একটি জাতির শক্তি। শিক্ষায় জাতির আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক।

তাই বলা হয় শিক্ষা একটি জাতিকে উন্নতির শিখরেই পৌঁছে দেয় না, একই সাথে একটি সুন্দর আলোকিত সমাজ গঠন ও বিপুল জনগোষ্ঠীকে যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। আর এসবের মূল সহায়ক শক্তিই হচ্ছে শিক্ষক সমাজ। মূলত তারাই এ গুরু দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন।

তারা অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর তাদের কেউ কোনো খবর রাখেনা। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এ্যারিষ্টটল বলেছেন, ‘যারা শিশুদের শিক্ষাদানের ব্রতী তাঁরা অভিভাবকের চেয়েও অধিক সম্মানীয়। পিতামাতা আমাদের জন্ম দেয় ঠিকই, শিক্ষকরা জন্মকে স্বার্থক করে তোলেন’।

আবার রুশো বলেছেন, সু-অভ্যাস গঠনের নাম শিক্ষা আর শিক্ষক, শিক্ষার্থীর সু-অভ্যাস নাম শিক্ষা, আর শিক্ষক শিক্ষার্থীর সু-অভ্যাস গঠনের নির্দেশক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গায়ের জোরে মোড়ল হওয়া যায়, সন্ত্রাসীও বটে, কিন্তু গুরু হওয়া যায়না। ফ্রেডরিক ফ্রয়েবেল বলেন, শিশু হলো উদ্যানের চারাগাছ। শিক্ষক হলেন তার মালী। শিক্ষকের কাজ হলো সযত্নে চারাগাছটিকে বড় করে তোলা।

শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৎ ও সামাজিক গুণাবলীর বিকাশ সাধন করা শিক্ষকের কর্তব্য। একথা অস্বীকার করার উপাই নেই যে, যে দেশ যত বেশি শিক্ষকদের নিয়ে ভাবেন, শিক্ষকদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধিতে আন্তরিক সে দেশ তত উন্নত। উন্নত রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলো।

জাপানে শিক্ষকদের সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, Better than a thousand days of daylight study is one day with a great teacher. অর্থাৎ হাজার বছরের অধ্যয়নের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ একজন মহৎ শিক্ষকের কাছে একদিন শিক্ষা গ্রহণ করা উত্তম।

তাই উন্নত রাষ্ট্রের শিক্ষকরা যেমন অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবি তেমনি তাদের সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। আমাদের দেশেও অনেক দক্ষ ও মেধাবি শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষার্থীদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষা শুধু সমাজকেই আলোকিতই করে জাতির মেধা মনন জাগ্রত, সভ্য জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার যে, মহান দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত তারা সমাজের শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। শিক্ষকরাই পারেন একটি অন্ধকার সমাজকে আলোকিত করতে। সমাজ রাষ্ট্রের এই গুরু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন শিক্ষক সমাজ।

সরকার টানা প্রায় ১৬ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায়। দীর্ঘ এ সময়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার পানি অনেক দূর গড়িয়েছে কিন্তু অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ভাতা ও অবসর ভাতার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন?

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে কেন? তাদের দুর্বিসহ মানবেতর জীবনে সুখ, শান্তির কোনো সুবার্তা নেই। যারা মানুষ গড়ার কারিগর তাদের জীবন আজ অর্থাভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাদের জীবন কিভাবে চলছে রাষ্ট্র সেদিকে নজর দিচ্ছে না। বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই শিক্ষা বান্ধব।

কিন্তু যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকারের দায়িত্বটা বেড়ে যায়। বর্তমান সরকার ১৬ বছর ক্ষমতায় তাই এ দায় এড়াতে পারে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে অর্থের কোনো সংকট নেই উপরোন্ত ঘুষ দুর্নীতির দ্বারা কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।

সেখানে অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতার জন্য তিন বছর চার বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন? গত ১৪ই জুন দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকের স্ত্রী অর্থাভাবে বিনাচিকিৎসায় মারা যায়।

উক্ত শিক্ষকের ছেলে-মেয়েরাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছেনা। শিক্ষকের হাত ধরেই যখন শিক্ষার রুপান্তর এবং শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয় এবং অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সুশিক্ষার দ্বারা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছলেও তাদের কারিগর অবসরে গিয়েও মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এটা রাষ্ট্রের কোন ধরনের আচরণ। অবসর জীবনে তাদের সংসার কিভাবে চলছে এটা কি রাষ্ট্র কোনোদিন ভাবে? যদি ভাবতো তাহলে কল্যাণ ও অবসর ভাতার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতোনা। বিষয়টি অত্যন্ত অমানবিক, নিন্দনীয় ও লজ্জাকর। সরকারের এ ধরনের উদাসীনতা নির্মম, নিষ্ঠুর।

অথচ শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু এ কারিগরের একাংশ যারা অবসর নিয়েছেন  তাদের মাসিক আয় তো নেই-ই উপরোন্ত অবসর ভাতার টাকা পেতে ও বছরের পর বছর সময় লাগে। আর এ দীর্ঘ সময় তারা অর্থাভাবে অতি মানবেতর জীবন যাপন করে। তাছাড়া অনেকেই অবসর ভাতা পাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবে তাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে। এটা সরকারের এক ধরনের তামাসা ছাড়া কিছুই নয়। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। আর শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি পরিবর্তনের ধারা আমাদের আশান্বিত করে। এ পরিবর্তনের ধারার পথে শিক্ষক সমাজই সম্পৃক্ত। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা।

এ পেশায় কোনো দুর্নীতি নেই, স্বজনপ্রীতি নেই, নেই কোনো দ্বন্দ্ব সংঘাত। তাই সমাজের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই শিক্ষকতাকে একটি মহান পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন একটি সম্মানযোগ্য অবস্থান থেকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। যখন একজন শিক্ষিত মানুষ শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করে তখন তার মনে বড় স্বপ্ন থাকে।

স্বপ্ন থাকে অবসর গ্রহণের পর অবসর ভাতার টাকা দিয়ে সংসারের অভাব অনটন পূরণ করবে, সন্তানাদির মুখ উজ্জল করবে। স্বপ্ন থাকে একটি মর্যাদা সম্পূর্ণ পেশায় অধিষ্ঠিত থেকে সমাজে এক সম্মানজনক অবস্থায় থাকবে। কারণ অন্যান্য পেশার চেয়ে শিক্ষকতা পেশার একটি আলাদা সম্মান ও সামাজিক মর্যাদা রয়েছে।

এ পেশার মানুষরা অধিকাংশই বিবেক সম্পন্ন, ঘুষ দুর্নীতি সহ অন্যান্য নেতিবাচক কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকে। কারণ বিবেক তাদের বাধা দেয়। পরিবার পরিজন নিয়ে একটু সুন্দরভাবে জীবন যাপনের স্বপ্ন থাকে, স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু সে স্বপ্ন আশা যখন বালু চরের মতো ভেঙ্গে যায় আশায় আশায় পথ চেয়ে বসে থাকে কিন্তু সে আশা, স্বপ্ন পূরণ হয় না তখন অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক নিজেকে বড় অসহায় মনে করে।

তখন তাদের দুঃখ কষ্টের সীমা থাকে না, তারা মাসের পর মাস, বছরের  পর বছর অবসর ভাতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে এটা কোনো ভাবেই যুক্তি সংঙ্গত নয়। শুধু অযৌক্তিকই নয় অমানবিকও বটে। সভ্য দুনিয়ার নিয়ম নীতি হতে পারে না। সারা জীবন শিক্ষা দানের মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থেকেও তারা অভাবমুক্ত জীবন পাচ্ছেন না যা সত্যিই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।

একটি জাতিকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে শিক্ষক সমাজ। সে শিক্ষক সমাজের একাংশ সময় মত অবসর ভাতা না পেয়ে চরম অবহেলিত জীবন যাপন করছে। ক্ষেত্র বিশেষে অর্থের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে যা গোটা জাতির জন্য অপমান ও লজ্জাজনক।

তবে আশার কথা এই যে, অতি সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে যে, বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর ভাতা ছয় মাসের মধ্যে প্রদান করতে হবে।

আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাইকোর্টের রায় সরকার মেনে চললেও এ ক্ষেত্রে কি হবে বা কতটুকু মানা হবে তা দেখার বিষয়। তবে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষাকল্পে এ রায় বাস্তবায়িত করা সরকারের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব।

প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সরকার যদি আন্তরিক হয় তাহলে কল্যাণ বা অবসর ভাতার জন্য শিক্ষকদের আর বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হবে না এবং তারা একটি সুন্দর, অভাবমুক্ত জীবন যাপন করতে পারবে।


লেখক : সাবেক শিক্ষক ও কলামিস্ট

01719-536231



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS