ভিডিও

ভোক্তার অধিকার ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট

আখতার হোসেন আজাদ

প্রকাশিত: জুলাই ০৬, ২০২৪, ০৭:৩২ বিকাল
আপডেট: জুলাই ০৬, ২০২৪, ০৭:৩২ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে আমাদের সমাজে স্বীকৃত হলেও ভোক্তা অধিকারও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সিংহভাগ নাগরিক জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধিকারটি সম্পর্কে জ্ঞাত নন। ফলে তারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে পণ্য কিনে বা সেবা ভোগ করে প্রতারিত হচ্ছেন।

অর্থনীতির ভাষায়, ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগ করার জন্য যিনি পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তাকে ভোক্তা বলা হয়। অর্থাৎ নাগরিকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ব্যতীত নিজে ভোগ করার জন্য যদি কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তবেই তিনি ভোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন। আইনের ভাষ্যমতে যিনি সম্পূর্ণ বা আংশিক মূল্য পরিশোধ করে অথবা সম্পূর্ণ বা আংশিক বাকিতে কিংবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা কেনেন, তিনিই ভোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন।

একজন নাগরিক যখন কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তা প্রতিশ্রুত ও গুণগত মান বজায় রেখে পণ্য বা সেবা ভোগের অধিকারকেই ভোক্তা অধিকার বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ভোক্তা অধিকার হলো অর্থের বিনিময়ে যথাযথ মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য ও সেবা লাভের অধিকারই। নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়া, পণ্যের উৎপাদনের উপাদান, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের সঠিক মূল্য জানা, গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে পণ্য পাবার অধিকারই হলো ভোক্তা অধিকারের অন্তর্গত। অর্থাৎ ন্যায্য মূল্যে ন্যায্য পণ্য বা সেবা পাবার অধিকারই হলো ভোক্তা অধিকার।

আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির মতে একজন ভোক্তার অন্যতম ৪টি অধিকার রয়েছে। যথা: নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং প্রতিকার পাবার অধিকার। একটি জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় এই অধিকারগুলো পরবর্তীকালে ভোক্তা অধিকার নামে পরিচিত লাভ করে।

ফলে মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তা অধিকারগুলো অনুমোদন লাভ করে আইনি স্বীকৃতি পায়। এভাবে পৃথিবীতে ক্রেতার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীকালে জন এফ কেনেডির বক্তৃতায় বর্ণিত ভোক্তা অধিকারগুলোকে বিস্তৃত করে জাতিসংঘ ৮টি অধিকারকে ভোক্তা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এগুলো হচ্ছে মৌলিক চাহিদাপূরণের অধিকার, তথ্য পাবার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাবার অধিকার, পছন্দের অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাবার অধিকার, শিক্ষালাভের অধিকার এবং সুস্থ পরিবেশে থাকার অধিকার।

এই অধিকারগুলো ভোক্তার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকার সমূহকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়ে মেনে চলছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬(ক) থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত বিভিন্ন  অনুচ্ছেদে এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সংক্রান্ত প্রচলিত বেশ কয়েকটি আইন জারি আছে।

প্রায় প্রচলিত চল্লিশটিরও অধিকার এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। যেমন তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯; নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩; পণ্য বিক্রয় আইন, ১৯৩০; ওজন ও পরিমাপ আইন, ১৯৮২; অত্যাবশ্যক পণ্য সামগ্রী আইন, ১৯৫৬ প্রভৃতি আইন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতা লাভের ৩৮ বছর পর নাগরিক তথা ভোক্তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে পূর্ণরূপে ভোক্তা অধিকার আইন তৈরি হয়।

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের পর বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালের ৬ই এপ্রিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন জারি করা হয়। এ আইনে বলা হয়েছে ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম রোধ ও এ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য এ আইনে প্রণীত হয়েছে।

এ আইনের ৮২টি ধারা ও অনেক ধারার উপধারা রয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইনটি বিস্তৃত পরিসরের আইন। এ আইনে খাদ্য, পণ্য, ঔষধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবাকে ভোক্তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক তথা ভোক্তারা বিভিন্নভাবে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারিত হলেও সচেতনতার অভাবের দরুণ তারা পান না কোনো প্রতিকার।

বর্তমান আধুনিক যুগে বাজারে এখনও সনাতনী পদ্ধতির পাল্লার বাটখারা ব্যবহৃত হচ্ছে। বিক্রেতাদের থেকে অহরহ ওজনে কম দেবার ফলে ভোক্তারা নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন। আবার বাজারে দেখা মেলে বিভিন্ন মুখরোচক পণ্যের। বিএসটিআই কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়া হরহামেশাই সেসব পণ্য উন্মুক্তভাবে বিক্রয় হচ্ছে।

এসব পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের উপাদান, উৎপাদন কিংবা মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ কিংবা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা থাকে না। ফলে ভোক্তারা যেমন বিভিন্ন ক্ষতিকর বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ উপাদান দ্বারা তৈরিকৃত পণ্য ক্রয় করছেন। ঠিক তেমনই নির্ধারিত মূল্য উল্লেখ না থাকার দরুণ তারা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্য ক্রয় করে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আবার বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে উৎপাদন বা মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। সচেতনতার অভাবের জন্য ক্রেতারা সেসব পণ্য না দেখেই ক্রয় করেন। ভোক্তাদের প্রতারণায় নতুনরূপে যুক্ত হয়েছে অনলাইনে পণ্য বিক্রয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব সহজেই চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

পরে মূল্য নিয়ে কাক্সিক্ষত পণ্য না দিয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। কখন বা পণ্য না দিয়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও ঘটে থাকে।

এছাড়াও বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশ না করা, সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয়, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্যের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি স্লোগান হলো ‘লঙ্ঘিত হলে ভোক্তা অধিকার, অভিযোগ করলে মিলবে প্রতিকার’। আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা হলো, দেশের নাগরিকরা প্রতারিত হলে কোথায়, কখন ও কীভাবে অভিযোগ করতে হবে, তা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন না। অভিযোগ করলে অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয় কিংবা হুমকি বা অন্য কোনো ক্ষতির ভয়েও অনেকেই অভিযোগ করতে চান না।

তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হলে অবশ্যই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানানো কর্তব্য। কোনো ব্যক্তি যদি পণ্য কিনে প্রতারিত হন, কিংবা প্রতিশ্রুত সেবা পেতে হয়রানির শিকার হন, তবে তিনি খুব সহজেই ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযোগ জানাতে পারেন খুব সহজেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক খোলা হটলাইন নাম্বার ১৬১২১ অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে পারেন। ইমেইলে অভিযোগ করার ঠিকানাটি হলো nccc@dncrp.gov.bd

এছাড়াও অনলাইনে www.dncrp.com ঠিকানায় ভিজিট করে অভিযোগ করা যেতে পারে। অভিযোগ করার সময় অবশ্যই পণ্য ক্রয়ের রশিদ, অভিযোগকারীর নাম, যোগাযোগের বিস্তারিত ঠিকানা, যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত মুঠোফোন নাম্বার, অভিযুক্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা, ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ মোতাবেক ভোক্তাকে অবশ্যই ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যেই অভিযোগ দায়ের করতে হবে।

অভিযোগ প্রমাণিত হলে মোট জরিমানার ২৫% অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেবার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। একইসাথে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন সম্পর্কে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রেডিও টেলিভিশন, পত্রিকায় রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়মিত প্রচার করতে হবে। ভোক্তা অধিকার ও ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত করলে এর শাস্তি তুলে ধরে নাটক, সিনেমা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তুকে আইনটি অন্তর্ভুক্ত করে এর গুরুত্ব শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরতে হবে।

এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। এছাড়াও ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতন নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবে নিজ পরিবার, আত্মীয় ও নিজ এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। পণ্য কেনার সময় নাগরিকদের পণ্য উৎপাদনের মেয়াদ ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, উৎপাদনের উপাদান, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, বিএসটিআই কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিল ও অনুমোদন আছে কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে।

অনলাইন প্ল্যাটফরম থেকে পণ্য কেনার সময় নির্ভরযোগ্য বিক্রয়মাধ্যম কিনা তার যাচাই করে নিতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কার্যক্রমকে আরো বিস্তার করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলায় সুচারুরূপে কার্য সম্পাদন করে উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমকে বিস্তৃত করতে হবে। ভোক্তা অধিকার ও খাদ্যে ভেজাল রোধে খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে স্বমন্বয় করে যৌথ কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ সালে প্রণিত হলেও আইনটি এখনও সার্বিকভাবে ছড়ানো সম্ভব হয়নি। একটি প্রবাদ আছে, ‘সুস্থ দেহ, সুন্দর মন, উন্নত জীবন’। তাই উন্নত জীবন সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও স্মার্ট নাগরিক। ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, তবেই তারা নিজেরা স্মার্ট নাগরিকে পরিণত হবেন।

আর স্মার্ট নাগরিকদের সমন্বয়েই বিনির্মাণ হবে সচেতন ভোক্তাবান্ধব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার স্মার্ট বাংলাদেশ। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট www.dncrp.portal.gov.bd
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
০১৭৯২-৩৮৭৪৩৮



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS