ভিডিও

কোটা না মেধা হোক যোগ্যতা

মোহাম্মদ নজাবত আলী

প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২৪, ০৫:১০ বিকাল
আপডেট: জুলাই ১৫, ২০২৪, ০৫:১০ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

আবার কোটা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিগত ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থী চাকরি প্রত্যাশিরা আন্দোলন শুরু করে। সে সময় আন্দোলন এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে কোটা বাতিল ঘোষণা করেন। সাধারণত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সকল শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে তাদের অধিকাংশ অভিভাবকই চান তাদের সন্তানরা শিক্ষাজীবন অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে অবশ্যই একটি ভালো সরকারি চাকরি পাবে এবং অবশিষ্ট জীবন সুখে শান্তিতে কাটাবে।

এ ধরনের প্রত্যাশা অভিভাবকের রয়েছে। কিন্তু কোটা ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় মেধাবীরাই সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে যে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে তাতে শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষকে মানবিক করার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থানের পথ তৈরি করে।

শিক্ষিত জনগোষ্ঠি তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থেকে দেশ জাতির সেবা করার সুযোগ পায়। তাই সেসব রাষ্ট্রগুলোতে যুগের চাহিদা অনুযায়ী এক ধরনের পরীক্ষিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকার ফলে বেকারত্ব কম।

আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৫৩ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে দেশে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, গবেষণা ধর্মী উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর যে হারে শিক্ষার্থীরা বের হয়ে আসছে সে হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে আমাদের দেশে বেকার সমস্যার কার্যকর কোনো সমাধানও হচ্ছে না। এর মূল কারণ বর্তমান আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও কোটা পদ্ধতি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা না পারছে একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক করে তুলতে না পারছে বেকারত্বের অবসান ঘটাতে।

প্রতিবছর হাজার হাজার বেকারের জন্ম দিচ্ছে বেকারদের বোবা কান্না তাদের দুঃখ কষ্ট আমাদের মতো অনেক অভিভাবকদের অবশ্যই ব্যথিত করে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে শিক্ষার অর্থ আত্ম কর্মসংস্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃত শিক্ষার অর্থ এই নয় যে, বেকারত্ব থাকা। বেকার জীবন মানেই অভিশপ্ত জীবন তবুও শ্রম বাজার ও চাকরির বাজারে যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পড়ে যা সব পরিবারের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

গত কয়েকদিন ধরেই শিক্ষার্থী-চাকরি প্রত্যাশিদের কোটা বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান সারাদেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। পুরো বাংলাদেশে অবরোধ কর্মসূচি চলছে। “বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন” ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশিদের দাবি সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালের সরকারের পরিকল্পনা পুনর্বহাল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী বলেন কোটা থাকবে না। সেই কোটা আজ কোথা থেকে এলো।

তিনি ছাত্রদের সাথে প্রহসন করেছেন বলেও অভিযোগ করেন। ক্রমান্বয়ে এ আন্দোলন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা ক্লাস, পরীক্ষা বর্জন করে রাস্তায় নেমে আসে। সরকার কেন যে, এ আন্দোলনে গুরুত্ব দিচ্ছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়। উপরšুÍ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোটা বিরোধী আন্দোলন অযৌক্তিক। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা যেতে পারিনা’। ভালো কথা।

আদালতের সব রায় কি মানা হচ্ছে? অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতা ৬ মাসের মধ্যে প্রদান করার যে রায় অতিসম্প্রতি আদালত দিয়েছে তা কি সরকার মানছে? সরকার ইচ্ছে করলে সবকিছুই করতে পারে। একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা সংস্কার করতে পারে।  ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে কোটা প্রথা বাতিল করা হয় (৪, অক্টোবর) এর ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়।

সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়ে কোটা প্রথা বহাল হওয়ায় আবার নতুন করে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। হবে না ই বা কেন।  বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তার ওপর কোটা পদ্ধতি গোদের ওপর বিষফোঁড়া। বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থায় প্রকৃত মেধাবীরা হতাশ। কোটার কারণে অযোগ্য দুর্বল মেধা সম্পন্ন চাকরি প্রার্থীরা অধিকাংশ সময় চাকরি পান আর প্রকৃত মেধাবীদের অনেকেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হয় এমন অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশে রয়েছে।

এমনিতে দেশে চরম বেকার সমস্যা। অধিকাংশ বেকারদের কোনো কর্মসংস্থান নেই। এ কারণে শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত ও চাকরি প্রার্থীরা রেলপথ, সড়কপথ অবরোধ করে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসুচি পালন করছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এদিকে গত  বুধবার কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের উপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দেয় আপিল বিভাগ। এর ফলে আন্দোলনকারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

একটা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, মানুষের জীবন যাত্রার মানের ওপর নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দারিদ্র পীড়িত দেশ। তবে দরিদ্রের হার অনেক কমলেও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে এখনো পৌঁছেনি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে, বাড়ছে পাশের হার প্রায় শতভাগ বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বলা যেতে পারে আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্জন একেবারে কম নয় বরং চোখে পড়ার মতো।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এ অর্জন বলতে বোঝাতে চাচ্ছি পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, জীবন যাত্রার মানও উন্নয়ন ঘটেছে। নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের এক কথায় বলা যেতে পারে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি রাষ্ট্রের মূল কারিগর হচ্ছে  দক্ষ মানব সম্পদ।

জনসংখ্যা একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক নয়, যদি বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করা যায়। কেননা শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ টেকসই উন্নয়নের পথে যেতে পারে না। আর শিক্ষা ছাড়া কখনই দক্ষ জনগোষ্ঠি তৈরি হতে পারে না। এ জন্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা, পরীক্ষা পদ্ধতি সে রাষ্ট্রকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছিতে বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে আত্মকর্মসংস্থান ও আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে সে ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি কর্মমূখী শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।

একটি গণমুখি উন্নত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা বেকারত্বের অবসান ঘটিয়ে দেশকে দ্রুত টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। উপরন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাই প্রকৃতপক্ষে জনকল্যাণমুখী বেকারত্ব দূরীকরণ প্রকৃত মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিচ্ছে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের একটি বড় অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে।

বেকারত্ব কতটা ভয়াবহতা সহজে অনুমেয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। সরকারি পদ শূন্য হওয়ার সাথে উক্ত পদে যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ দিয়ে বেকারের সংখ্যা হ্রাস পাবে। প্রতিবছর যেভাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে সেভাবে নিয়োগ দেয়া কিন্তু হচ্ছে না। অথচ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে শূন্য পদ রয়েছে।

এ শূন্যপদগুলো দ্রুত পূরণ করতে না পারলে বেকারের সংখ্যা আরও ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে এবং সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। আর সরকারি চাকরিতে কোটা থাকায় প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে। যার কারণে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে সমর্থন জানাচ্ছেন শিক্ষার্থী-চাকরি প্রত্যাশিরা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোটা বিরোধী আন্দোলন অযৌক্তিক। কিন্তু কোটা সংস্কারের পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। একদিকে মেধা সম্পন্ন চাকরি প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সঙ্গত কারণে আন্দোলনকারীদের দাবীর পক্ষে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের। দেশের সচেতন নাগরিক বিশেষজ্ঞ মহল কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে। বর্তমানে দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে শুরু করে সরকারি চাকরির বিরাট অংশ দখল করে আছে কোটা পদ্ধতি।

সরকারি চাকরি বিসিএস, প্রাইমারী স্কুলে চাকরির ক্ষেত্রে সবখানে কোটা পদ্ধতি জালের মতো বিস্তার করে আছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার কারণে প্রকৃত মেধাবীরা ঝরে পড়ছে। মেধাবীরা পরীক্ষায় ভালো করেও কোটার কারণে তাদের চাকরি হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি চাকরিতে অপেক্ষতম কম মেধা সম্পন্নরা সুযোগ পাচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ বেকার যুবক। কোটা পদ্ধতির অপব্যবহারের ফলে প্রতিবছর বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে।

মুক্তিযোদ্ধা, তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনী, পোষ্য, খেলোয়াড়, প্রতিবন্ধী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সহ নানা ধরনের কোটা বাংলাদেশে রয়েছে। অথচ মেধা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীদের ঝরে পড়তে হয়। কোটার কারণে মেধাবীদের ভাগ্যাকাশে কালো মেঘের ছায়া পিছু ছাড়েনা। আর শিক্ষিত বেকাররা হতাশায় ভুগছে। সরকারি চাকরির ১ম ও ২য় শ্রেণির ৫৬শতাংশ কোটাধারীদের দখলে। অন্যদিকে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৭০শতাংশ নিয়োগ দেয়া হয় কোটা থেকে। অবশিষ্ট ৩০শতাংশ মেধা তালিকা থেকে।

তাছাড়া বিসিএসএও কোটাধারীদের নিয়োগ দেয়ার তো অভিযোগ রয়েছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে-মেয়ে, নাতিপুতির সরকারি চাকরিতে কোটা কতটা যৌক্তিক তা ভাবা দরকার। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সংস্কার করে প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়নের দাবীতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার আন্দোলনও হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা কোটা বেকারত্বের অবসানে বড় অন্তরায়। বাংলাদেশে কোটার ব্যবহার প্রবল আকারে।

যে যা-ই বলুক না কেন বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা মেধাবীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তাই কোটা পদ্ধতি বাতিল না করে তা সংস্কার করা প্রয়োজন। আমরা মনে করি সরকারি চাকরিতে যে, বিদ্যমান  কোটা ব্যবস্থা রয়েছে তা সংস্কার করা প্রয়োজন। যাতে করে প্রত্যেকেই তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরি পেতে পারে।


লেখক : সাবেক শিক্ষক ও কলামিস্ট

tnalichs@gmail.com

01719-536231



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS