ভিডিও

প্রজন্মের কথা ভাবুন! দুর্নীতি ও প্রতারণা বন্ধ করুন

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২৪, ০৬:১৯ বিকাল
আপডেট: জুলাই ২৭, ২০২৪, ০৬:১৯ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি হয়ে থাকে। লোভ ও অতিরিক্ত ভোগের আকাক্সক্ষা থেকেই দুর্নীতি কিংবা প্রতারণার উৎপত্তি হয়। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি দায়িত্ব পালনের বিধিবিধান ও কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কাউকে কোনো সুবিধা দেয়া হলো দুর্নীতি।

আর প্রতারণা হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে কোন কিছু সমাধানের সক্ষমতার কারণে পুরস্কার গ্রহণ করা। সাধারণত প্রতারণা করা হয় আইন অমান্য করে, যাতে প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে অসম সুবিধা পাওয়া যায়। দুর্নীতি ও প্রতারণা শুধু সরকারি অফিসে সীমাবদ্ধ নেই।

সমাজের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। কেবল অভাবের তাড়নায় মানুষ দুর্নীতি করে-এটি সত্য নয়। বিত্তশালী কর্মকর্তা বা ব্যক্তি আরো অর্থ সম্পদের জন্য দুর্নীতি কিংবা প্রতারণা করে। মানুষের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার ঘাটতি হলেই দুর্নীতি জেঁকে বসে।

দেশের প্রচলিত দুর্নীতির ব্যাপকতা পর্যালোচনা করলে সত্যিই হতাশ হতে হয়। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে প্রতিটি পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যেও কম-বেশি দুর্নীতি রয়েছে। যত দিন যাচ্ছে, দুর্নীতির ব্যাপকতা ততই বাড়ছে। আমাদের দেশের জনগোষ্ঠী সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী।

এরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য রক্ত দিয়েছে। আবার ধর্মপ্রাণ, পরোপকারী, অতিথিপরায়ণ ও সহজ-সরল মানুষ হিসেবে দেশ-বিদেশে সুনামও রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে মিথ্যাচার, প্রতারণা, পরনিন্দা, স্বার্থপরতা,পরশ্রীকাতরতা ও অসততার দুর্নাম।

লোকমুখে যেসব অভিযোগ সচরাচর শোনা যায় সেগুলো হলো-সরকারি অফিসে তদবির অথবা টাকা না দিলে কাজ হয় না। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা অতিমুনাফাখোর, বিশেষ বিশেষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় কোনো কার্যোপলক্ষে টাকা না দিলে ন্যায্য কাজ তো হবেই না, বরং অহেতুক হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় ইত্যাদি।

দেশে দুর্নীতির ব্যাপ্তি দেখে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে, আমাদের গোড়ায় গলদ রয়েছে। আমরা বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসন, স্বৈরাচার, একনায়ক কর্তৃক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছি। নীতি-নৈতিকতার শিক্ষায় আমাদের রয়েছে বিরাট ঘাটতি। কি পরিবার, কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কি সমাজ কোথাও সততা ও নীতি-নৈতিকতাকে এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয় না।

ব্যক্তিস্বার্থকে আমরা জনস্বার্থ বা সমষ্টিগত স্বার্থের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিই। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ন্যায়-অন্যায় বিচার করি না। যেসব সংস্থা দুর্নীতি বিষয়ে গবেষণা ও রিপোর্ট করে তাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি যেসব অফিসে সরাসরি জনসাধারণের কার্যোপলক্ষে যাতায়াত রয়েছে সেসব অফিসে দুর্নীতি বেশি হয়। তালিকাভুক্ত না করেও বলা যায়, যেখানে অর্থ খরচ কিংবা কোনো অনুমোদন প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানেই কমবেশি ঘুষ-দুর্নীতির সম্ভাবনা রয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে আমাদের শিক্ষা খাতও রেহাই পায়নি। বেশ কিছুদিন হয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছেন। কোটা নিয়ে ২০১৮ সালে আরও বড় আন্দোলন হয়েছিল এবং সে আন্দোলনের ফলে কোটা নিয়ে একরকম ফয়সালাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি আদালতের একটা রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলন করছেন। তাঁদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা তো অবশ্যই আছে।

কারণ, তাঁদের আন্দোলনের ফলে সরকার তাঁদের দাবিটা আগেই মেনে নিয়েছিল। কেন শিক্ষার্থীদের আবার এমন একটা আন্দোলনের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। শিক্ষার্থীরা কেউই কোটা বাতিল করার কথা বলছেন না; বরং কোটা সংস্কারের কথাই বলছেন। অন্য আরও কোটা থাকলেও সমালোচনা হচ্ছে মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কিংবা তাঁদের পরিবারকে যদি সাহায্য করতে হয়, তাহলে সরকার তো অন্য অনেকভাবে সাহায্য করতে পারে এবং নানাভাবে তা করাও হচ্ছে, যা খুবই প্রশংসনীয়।

তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোটা একটি প্রজন্মের জন্য যৌক্তিক ছিল, কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম মানে নাতিপুতিরাও সেই সুবিধা পেয়ে যাবে, তা কোন বিবেচনায়? কোটা আন্দোলন নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন মাঠে সরব, ঠিক তখনই চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের একটি অনুসন্ধানের প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন এক যুগ ধরে নিয়মিত ভাবে ফাঁস হয়ে আসছে। এখন এই খবর যদি সত্য হয়, তাহলে এর দায়টা কে নেবে?

দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের স্বপ্ন থাকে পড়াশোনা শেষে বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরিতে যোগদান করার। তো তাঁদের মধ্যে যেসব মেধাবী প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য চাকরিটি পায়নি তাঁদের দায়ভার কে নেবে? কাউকে না কাউকে তো এর দায়ভার নিতে হবে। জানা গেছে, বিপিএসসির কিছু কর্মকর্তা এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এর চেয়েও বড় ভয় ও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে যাঁরা সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁদের নিয়ে।

যেই ছেলেমেয়েরা এখন আন্দোলন করছেন, তাঁদের অনেকেই চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেবেন। তাঁদের মধ্যে একধরনের শঙ্কা কাজ করবে, তাঁরা হয়তো মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পাবেন না। ভয়, শঙ্কা ও আশঙ্কা নিয়ে কি মেধার চর্চা করা সম্ভব? তাঁদের মধ্যে সব সময় একটা সংকোচ কাজ করবে। যাঁরা বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চাকরি পান, তাঁরা আসলেই মেধাবী।

সেই জায়গা যদি সংকুচিত, কলুষিত হয়ে যায়, তাহলে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা কোথায় যাবে? যারা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত; তাদের কারও কি বিচার হবে? এখন তো জানা যাচ্ছে, বিপিএসসির যেসব কর্মকর্তা, কর্মচারী প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাঁদের অনেক টাকাপয়সা, গাড়ি-বাড়ি হয়ে গেছে।কেউ আবার এলাকায় বড় নেতাও হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেখা গেছে, বিপিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক একজন গাড়িচালক এখন বিশাল ব্যবসায়ী এবং এলাকার জনদরদী নেতা।

প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে তাঁর নাম এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি অফিসে গাড়িচালকের চাকরি করে কীভাবে তিনি এত বড় ব্যবসায়ী হলেন। এও দেখা যাচ্ছে, তিনি ও তাঁর ছেলে দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করছেন।বিপিএসসির প্রশ্নফাঁস নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন সরব। কিন্তু এতদিন কি এ সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না? কেন কেউ এসব নিয়ে এতদিন প্রশ্ন করেনি? সরকারের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এতদিন কী করেছে? এখন এ ঘটনায় যদি কারো বিচার না হয়, তাহলে তো ভবিষ্যতে এমন আরও কান্ড হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

তা ছাড়া বিপিএসসির কর্তাব্যক্তিরা কেন এর জন্য ক্ষমা চাইবেন না? তাঁদের তো অবশ্যই কৈফিয়ত দিতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সে ব্যাপারে আস্থার জায়গাটাও তাঁদের তৈরি করতে হবে। তাঁদের যদি বিচার না হয়, তাঁরা যদি ভুল স্বীকার না করেন, যদি কৈফিয়ত না দেন তাহলে ধরে নিতে হবে, তাঁরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাহলে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎটা আসলে কোথায়? এসব ঘটনার কি কখনো কোনো বিচার হবে না? চলতেই থাকবে? তরুণ প্রজন্মকে আর কত অন্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে? তাঁদের আর কতভাবে প্রতারিত হতে হবে? এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

এমনিতেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের বিশাল একটা অংশ আজকাল পড়াশোনা শেষে বিদেশে পাড়ি জমাতে চান। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফলে আমরা যে আরও অনেক মেধাবীকে হারাচ্ছি না; এর নিশ্চয়তা কোথায়? কোটা আন্দোলন নিয়ে যেমন ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার হচ্ছেন, তেমনি ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোটায়’ সরকারি চাকরি পেয়ে যাঁরা রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন,  তাঁদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হওয়া উচিত। নইলে দেশ ও সমাজের ওপর যে কালো ছায়া নেমে আসবে। সে কালো ছায়া ভেদ করে আলো হয়তো আমাদের সমাজে আর নাও আসতে পারে।

দুর্নীতির কারণে মানুষের নীতি-নৈতিকতা নষ্ট হয়। শুধু তা-ই নয়, দুর্নীতি দেশের সামাজিক পরিবেশ, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নষ্ট করে। দেশে বৈষম্য বাড়ে। সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাশালীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে আমজনতা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতিবাজরা নির্দ্বিধায় দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে অর্থ পাচার করছে।

এক হিসাব অনুযায়ী জানা যায়, প্রতি বছরে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে বা অন্যান্য উপায়ে ব্যাংকের টাকা লুট করে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পরিচালক কিংবা ব্যাংকের ক্লায়েন্ট বিদেশে চলে যাচ্ছেন। অর্থ-সম্পদ না থাকলে আজকাল ভোটের রাজনীতিতেও আসা যায় না। অথচ দেশের অব্যাহত অগ্রগতি সারা বিশ্বের বিস্ময়। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫২ বছরে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি হয়েছে তার পেছনে রয়েছে সরকারের নানা নীতিসহায়তা, উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের শিল্প স্থাপন, কর্মসংস্থান, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান।

উন্নয়নের এ পর্যায়ে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচ্ছন্ন দুর্নীতির কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের মান খারাপ হচ্ছে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের বিষয় যেমন বিশ্বব্যাপী আলোচিত হচ্ছে, তেমনি দুর্নীতির বিষয়টিও কারো অজানা নয়। দেশে দুর্নীতির প্রকোপ এতটা বেশি যে বর্তমানে মানুষের চিন্তা-চেতনায়ও এটি সংক্রমিত হচ্ছে, অথচ এ দেশে এরূপ বেপরোয়া দুর্নীতি মোটেও কাম্য নয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সৎ ও যোগ্যদের যথাস্থানে বসিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিতে হবে। জনগণকেও এ ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রজন্মকে দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখতে হবে।আর এতে করেই দেশের সুনাম যেমন অক্ষুন্ন থাকবে তেমনই এগিয়েও যাবে দেশ।


লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

raihan567@yahoo.com

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS