ভিডিও

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও দুর্নীতির রাহুগ্রাস

সাব্বির পল্লব

প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২৪, ০৬:০১ বিকাল
আপডেট: জুলাই ৩০, ২০২৪, ০৬:৩৩ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

"শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড" এই সহজ সরল সত্য কথাটা যে জাতি যতো সহজে বুঝতে পেরেছে, সেই জাতি খুব সহজেই উন্নতির চরম শিখরে পৌছেছে। বিশ্বব্যাপী সকল উন্নত দেশের দিকে এক নজর তাকালেই সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।

ঐসব দেশ সমূহে রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে থাকলো না থাকলো সেই দিকে ন্যূনতম গুরুত্বারোপ না করে প্রকৃত অর্থে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক শতভাগ পরিচালিত আধুনিক যুগোপযোগী বিজ্ঞানসম্মত একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখার ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে তারা ব্যাপকভাবে সাফল্য পেয়েছে বলেই আজ তারা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই বলেই শিশুকাল থেকে বয়সের সাথে সমন্বয় রেখে সহজ-সরল সাবলীল ভাষায়, সামান্য মানসিক চাপের সম্মুখীন যেন না হয় তাই কখনো খেলার ছলে আবার কখনো ঐ বয়সের মনোরঞ্জনের সাথে তাল মিলিয়ে মেধার ভিত্তিতে পাঠদানের পদ্ধতি চালু রেখে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিটি শিশুর সুন্দর আগামী রচিত হওয়ার লক্ষ্যে।

পাশাপাশি যদি আমাদের দেশের শিক্ষা পদ্ধতির কথা চিন্তা করলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য খুব সহজেই বোঝা যায়। স্বাধীনতা পূর্ব হতে দাবি করা বাঙালির ঐতিহ্য কে সমুন্নত রেখে একমুখী আধুনিক যুগোপযোগী বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষানীতি স্বাধীনতা উত্তর পাঁচ দশকের অধিক কাল অতিবাহিত হওয়ার পর আজও কল্পনা ও স্বপ্নের রাজ্যের ঘূর্ণিপাকে অবস্থানরত।

নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা কে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরকরণ, শিক্ষকদের মাঝে দলীয়করণ ও পাঠদানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কে বাদ দিয়ে অন্যত্র স্থানে উৎসাহিত করা সহ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আমাদের  শিক্ষা ব্যবস্থা পেছাতে পেছাতে আজ বিশ্বব্যাপী শিক্ষার মানদন্ডের জরিপ মতে ১৩৮টা দেশের মধ্যে আমাদের দেশের শিক্ষার মান ১২৩তম। শুধু তাই নয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্নে এর অবস্থান।

এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান আজ কোথাও নেই বললেই চলে। কথায় বলে " পেটে সইলে পিঠে সয় " এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে মানুষ গড়ার কারিগর সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের জীবনযাত্রা নিয়ে আলোকপাত করলে দেখা যায় যারা সরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষক তাদের বেতন সরকারি সব সুযোগ সুবিধা সহ এই দুর্মূল্যের বাজারে সন্তোষজনক না হলেও নেহায়াতই কম নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি বেসরকারি এম.পি.ও ভুক্ত স্কুল কলেজের শিক্ষকদের বাস্তব পরিস্থিতি খুবই লজ্জাজনক।

একজন এম.পি.ও ভুক্ত শিক্ষক চাকুরীতে যোগদানের মুহূর্তে মূল বেতন ১২৫০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ১০০০টাকা চিকিৎসা ভাতা ৫০০টাকা এবং চাকুরী থেকে অবসরে যাওয়ার সময় সব সহ সর্বোচ্চ প্রায় ৩২০০০ টাকা। একই ভাবে কলেজ শিক্ষকদের মূল বেতন ২২০০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ১০০০ টাকা, চিকিৎসা ৫০০টাকা এবং অবসরে যাওয়ার সময় সর্বোচ্চ প্রায় ৪৭০০০ টাকা।

প্রতি বছর ৫০০ টাকা ইনক্রিমেন্ট যোগ হওয়ার পর এই সর্বোচ্চ বেতন দাঁড়ায়।  এই মধ্যে ১০% কেটে রাখা হয় অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর সেটা প্রদান করা হয়। শহরকেন্দ্রিক হাতেগোনা সর্বোচ্চ ৪/৫ টি স্কুল কলেজের সামর্থ্যানুযায়ী নিজস্ব তহবিল থেকে কিছু বেতন-ভাতা দেওয়া হয়।

ব্যক্তি মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা না থাকায় মালিকের মানসিকতার উপর নির্ভর করে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা। প্রসঙ্গক্রমে কথা এসে যায় বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষকদের এই সামান্য বেতনে জীবনধারণ মোটেও সম্ভবপর নয়।

কর্মস্থলের আশেপাশে সবার নিজস্ব বাড়িঘর নেই, বেশিরভাগই দূর দূরান্ত জেলা উপজেলা থেকে এসে শিক্ষকতা করেন বিধায় তাদের বাড়ি ভাড়া, সংসার খরচ, অসুখ বিসুখের খরচ বাদেও বাবা মাকে হয়তোবা খরচ পাঠাতে হয়, অন্যান্য মা বাবার মতো শিক্ষক দম্পতিও তাদের সন্তানকে ভালো স্কুল কলেজে লেখাপড়া করাতে চায় যদিও সেটা তাদের সাধ্যের বাহিরে।

তখন বাধ্য হয়ে বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে না হলে কোচিং ব্যবসার সাথে জড়িয়ে যায়। কোচিং ব্যবসায় শিক্ষক ছাড়াও লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত তরুণ তরুণী জড়িত আছে যেখানে চাকুরী নামক সোনার হরিণ তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। মোটামুটি সম্মানজনক বেতন সরকারি শিক্ষকগণ পাওয়ার পরেও কোচিং এর সাথে তারা প্রায় সবাই জড়িত। কোচিং ব্যবসা বন্ধের নিমিত্তে নানান উদ্যোগ নেওয়া হয় ঠিকই কিন্তু বন্ধ করা সম্ভব হয়নি সম্ভব হচ্ছে না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতি না হওয়ার প্রথমত অন্যতম প্রধান কারণ বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা। দ্বিতীয়ত শিক্ষাকে বাণিজ্য করণের ফলে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য একধরনের আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জন্য আর একধরনের শিক্ষা। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার তাদের দলীয় মনোভাবাপন্ন লোকদের নিয়ে শিক্ষার পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছে ঠিকই কিন্তু সফলতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা বাদ দিয়ে শুরু হলো পি.এস.সি ও জে.এস.সি আবার এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ডিভিশন পদ্ধতি চলার মাঝে মেধা যাচাইয়ের নতুন প্রক্রিয়া গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হলো। এর মাধ্যমে প্রকৃত মেধা যাচাই বাঁধাগ্রস্ত হতে যখন শুরু করলো তখন এই পদ্ধতিটিও বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ২০২৬ সাল থেকে মূল্যায়ন হবে বর্ণ পদ্ধতিতে।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলে আসা পাঠদান পদ্ধতি বাতিল করে নতুন করে চালু হলো সৃজনশীল পদ্ধতি, সেটাও বেশ কয়েকবছর চলার পর সুবিধাজনক না হওয়ায় বাতিল হলো, এখন নতুন করে এসেছে মূল্যায়ন পদ্ধতি। শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার চেষ্টা করছে কিন্তু সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান।

সাম্প্রতিক সময়ে মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কোঠা পদ্ধতি সংস্কার ও নতুন প্রজ্ঞাপন জারি প্রশংসিত হলেও মেধা যাচাইয়ে বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি প্রধান অন্তরায়। দল মতের উর্ধ্বে উঠে জ্ঞানের ভান্ডারে আলোকিত, সর্বজন শ্রদ্ধেয়, প্রকৃত শিক্ষাবিদদের কে সাথে নিয়ে একটা একমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সময়ের প্রেক্ষাপটে অতি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে কিছুতেই মুক্ত হতে পারছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল ও কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে চাইলে ১০/১৫/২০ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রদান করার সামর্থ্য থাকতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে আসা এই নিয়োগ বাণিজ্যের ফলে মেধাবীরা এই পেশাতে আসেনি, এসেছে পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা কোনোভাবে পাশ করেছে যারা।

তাই এদের কাছ থেকে আর যাই হোক ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভালো মানের শিক্ষা প্রদান আশা করা যায় না। অবশ্য অতি সাম্প্রতিক সময়ে পি.এস.সি এর মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করায় কিছুটা হলেও এই ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে ঠিকই কিন্তু স্কুল কলেজ যে সকল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় সেই সব প্রতিষ্ঠান ঘুষের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ করে বিভাগীয় শিক্ষা বোর্ড ও জেলা পর্যায়ের অফিস গুলো। প্রাতিষ্ঠানিক কাজে প্রতিনিয়ত স্কুল কলেজ প্রধান কিংবা অন্য কাউকে যেতে হয় এই অফিসগুলোতে কিন্তু যে কোনো কাজ করতে গেলে কথা বলতেই দিতে হয় ঘুষ, আর কাজের ক্ষেত্রে ঘুষের মাত্রা লাগামহীন। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যয় করা এই ঘুষের টাকার হিসাব কি ভাবে করবে প্রতিষ্ঠান প্রধান।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় ঘুষ প্রদান করা হয়েছে এই মর্মে কোনো ভাউচার তৈরি করতে পারবে না। তাকে শতভাগ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ভূয়া ভাউচার জমা দিতে হবে। এইক্ষেত্রে ভূয়া ভাউচারে প্রকৃত খরচের চেয়ে আরো দুইতিন গুণ বৃদ্ধি করে বিশাল অঙ্কের ভূয়া ভাউচার তৈরি অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এইভাবে হরেক রকমের খরচের ভাউচার জমা হচ্ছে পরিচালনা পর্ষদের সহযোগিতায় বহাল তবিয়তে সেটা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মঞ্জুর হচ্ছে। আর এক ধরনের ক্ষুদ্র হলেও দুর্নীতি সেটা হলো স্কুল কলেজে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক  পরীক্ষার কেন্দ্র হয়ে থাকে সেখানেও অনিয়ম। কেন্দ্রগুলোতে যেসব শিক্ষক পরীক্ষা হলে ডিউটি দেন তাদের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে নির্ধারিত সম্মানী ভাতা থাকে। সমস্ত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সেই টাকা ডিউটি অনুযায়ী পেয়ে থাকেন।

সেখানেও দুর্নীতি যেমন শিক্ষকরা যে পরিমাণ টাকায় স্বাক্ষর করেন সেই পরিমাণ টাকার চেয়ে অনেক কম পেয়ে থাকেন আর এই কম পাওয়া টাকাগুলো স্তর ভেদে ১৪/১৫ টি খামে ভরে চলে যায় বিভিন্ন দপ্তরে, এ যেনো এক অলিখিত নিয়ম।

যে শিক্ষক ঘুষ দিয়ে চাকুরী পায় এবং প্রশাসনিক নানান জায়গায় বাধ্য হয়ে ঘুষ প্রদান করতে বাধ্য হয় সেই শিক্ষকের কাছ থেকে কি করে আশা করা যায় উন্নত শিক্ষা প্রদান অথবা দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে গড়ে উঠবে সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক প্রজন্ম যাদের নেতৃত্বে চলবে আগামীর বাংলাদেশ।



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS