অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার
বিগত দীর্ঘ একমাসে আমাদের অদম্য তরুণ সমাজ যে অসাধ্য কাজটি সাধন করেছেন তাতে একজন পিতা হিসাবে যেমন গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে। একইভাবে সবার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস গভীর হচ্ছে। একজন শিক্ষক হিসাবে তাদের কাছে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনার ধারাবাহিকতা ও দূঢ়তার যথার্থ প্রায়োগিক প্রতিফলন হতে শিক্ষা গ্রহণ করছি।
যেখানে আমাদের এই প্রগতিশীল রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে এই নিরন্ত্র মেধাবীরা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সফলতা অর্জন করেছেন। এই প্রজন্ম তথ্য ভিত্তিক স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ধারণা থেকেই বৈষম্যতা অনুধাবন করেছেন। এই বৈষম্যতা যেমন শুরু করেছিলেন কোটা হতে। যা সংস্কার করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। সেই কোটা সংস্কারের পথ ধরেই তাদের মাথায় এসেছিল বৈষম্যতার পর্বতসম অবস্থা।
তাদের চিন্তায় ধরা পড়ে রাষ্ট্রের সকল যন্ত্রের উপর। তাদের নজরে আসে স্বাধীন দেশের এমন পরাধীন ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। একজন কৃষক, দিন মজুর বা নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ থেকে শুরু করে সকল স্থানেই বৈষম্যতা। তবে দুর্বলের জন্য তা যেন আরও অনেক অনেক ধাপ এগিয়ে।
একজন দিনমজুর কৃষকের সন্তান যখন দরিদ্রতার চরম কষাঘাতের নির্মমতায় লড়াই করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে পড়াশুনার পরও নিজ মেধায় উপযুক্ত চাকুরিতে সুযোগ পাচ্ছে না। তাই সেই বৈষম্যতা নিরসনের জন্যই তাদের দাবি ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার তাদের অধিকারের দাবির প্রতি অতটা কর্ণপাত না করায় বৈষম্যতা ও নির্মমতা বাড়তে থাকে। ছাত্র সমাজকে করতে হয় এক বিশাল ত্যাগ। দিনের পর দিন ঝরতে থাকে সম্ভাবনাময় তরুণ ও শিশুর প্রাণ।
এত বেশি প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলার ২য় স্বাধীনতা। কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা অনেক কঠিন। এই স্বাধীনতা তখনই টেকসই হবে, যখন তাতে স্বচ্ছতা ও সহনশীলতার সাথে জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা থাকবে। গত ৫ই আগষ্ট বিজয় অর্জনের পর এক ধরনের উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে যা বিজয় উল্লাসকে ছাড়িয়ে গেছে। এ রাষ্ট্রের প্রতিটি সম্পদই আমাদের নিজেদের ট্যাক্সের টাকায় কেনা। গণভবন, সংসদভবন সহ সকল প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রের।
তাই উল্লাসের নামে এগুলোকে ধ্বংস করা অবশ্যই দেশ-প্রেমের পরিচায়ক নয়। আমরা সবাই দেশ প্রেমিক কোন ফ্যাসিষ্ট-রেজিম নই। আবার এই বিজয়ের সুযোগে অনেকে ব্যক্তিগত জিঘাংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যস্ত যা কখনই সমর্থন যোগ্য নয়। একইভাবে সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ কোন মানবতার মধ্যেই পড়ে না। জানি অনেক অনেক অন্যায় অবিচারের শিকার হয়েছেন। তার জন্য অব্যশই নিরপেক্ষ তদন্তে ন্যায় বিচারের পথ খোলা আছে।
কখনই কোন নিপিড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন না। তাহলে ফ্যাসিষ্ট-রেজিম এবং আপনার মধ্যে কোন পার্থক্যই থাকবে না। মনে রাখতে হবে আপনার দায়িত্ব অনেক। কোমলমতি প্রজন্ম আমাদের এই বিশাল অর্জন দিয়েছেন। তাই আপনার দায়িত্বও বেড়ে গেছে অনেকগুণ। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গই সংস্কার প্রয়োজন। সবার আগে দরকার একটি নিরপেক্ষে নির্বাচন। একই সাথে যাদের রক্তের বিনিময়ে এই অর্জন তাদের জন্য এক ইনসাফ কায়েম করা।
যে মায়ের বুক খালি হয়েছে সেই মায়ের হাহাকার পূরণের ব্যবস্থা করা। আবু সাঈদ, মুগ্ধদের অপূরনীয় ক্ষতির যথাযথ লাঘব করা। মানুষের অধিকার এবং মানবাধিকার সংরক্ষণে বৈষম্যতা দূর করা। চিন্তা করুন আয়নাঘর বা গুমের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল তা কতটা ভয়ঙ্কর। বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড কতটা বিভীষিকাময়। এগুলোর প্রতিকার নিশ্চয়তা কত বেশি প্রয়োজন।
বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা চর্চার পরিবর্তে যে দল চর্চার প্রতিযোগিতা আর ¯ুÍতিকারক কার্যে নিমজ্জিত শিক্ষকদের সংস্কার কত বেশি প্রয়োজন। দায়িত্বশীল নাগরিকের ভুমিকা পালন করতে হবে। বিজয় অর্জন হয়েছে ন্যায়ের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কোন অন্যায় জুলুম ও অবিচারের শিকার যেন কেহ না হয় সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এক নতুন সূর্যের নির্মল বিকিরণে উদ্বেলিত হয়ে প্রিয় জন্মভূমির সকল অপশক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক ও আইনের ধারাবাহিকতায় নির্মূল করতে হবে। কোন হায়েনা আর অপশক্তি যেন কোনভাবেই আর মাথা চাড়া দিতে না পারে সেই বিষয়টি বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। কেউ যেন কোনভাবেই নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার সুযোগ না পায়। প্রিয় কোমলমতি ছাত্র /ছাত্রীদের পড়া-শুনার বিরাট ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা অতীব জরুরি।
স্কুল, কলেজ, বিশ^বিদ্যালয়গুলিতে দ্রুত কর্মচঞ্চল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধিদ্বীপ্ত শক্তিশালী জাতি গঠনের ব্রতে নিয়োজিত হওয়াই হবে মূল উদ্দেশ্য। একটি দেশ কখনই গবেষণা ছাড়া উন্নত লাভ করতে পারে না। পারে না বিশে^ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অবশ্যই গবেষণার কাজেই ব্যয় হবে। জনস্বাস্থ্যে গবেষণার কোন বিকল্প নেই। জনস্বাস্থ্য খাতটি যদি উন্নত না হয় তাহলে কিভাবে একটি শক্তিশালী জাতি গঠন সম্ভব হবে।
জনস্বাস্থ্য আমাদের দেশে বরাবরই অবহেলিত ক্ষেত্র। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটেছে দ্রুত গতিতে। আউট পকেট এক্সপেনডেচার ক্রমেই বেড়ে চলছে। এক গবেষণার দেখা গেছে মানুষের দরিদ্রতার মূলত প্রধান দুটি কারণের মধ্যে একটি হলো চিকিৎসা ব্যয় এবং অন্যটি হল মামলা সংক্রান্ত ব্যয়।
তাই সংস্কার সকল জায়গাতেই প্রয়োজন। এখন আত্মতৃপ্তির সময় নয়। সময় এখন প্রিয় মাতৃভূমিকে ঢেলে সাজানোর। তাই আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলি।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কীটতত্ত্ব বিভাগ
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)
মহাখালী, ঢাকা
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।