ভিডিও

জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস

এড. মোঃ মোজাম্মেল হক

প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২৪, ০৬:০১ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ১৮, ২০২৪, ০৬:০১ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

বাঙালিদের গণতন্ত্রের স্বাদ নিতে বহু পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও স্বাধীনতার স্বাদকে খুঁজতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্যে স্বাধীনতার ডাক আসে, আমরা পাকিস্তানী জালিমশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, যে যুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দেয়, দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম এর বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতার সুফল আমরা কি পেয়েছি ? আমরা কি বাক স্বাধীনতা পেয়েছি, আমরা কি অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ পেয়েছি?

এই সকল প্রশ্নের উত্তর পাওয়া বড় কঠিন। স্বাধীনতার পর আমরা কত সময় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পেয়েছি ? বিগত ১৫/১৬ বছরে দেশ গণতন্ত্রের নামে কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মধ্যে ছিলো। এই সময় ছিলো না কথা বলার অধিকার, ছিলো না মানুষের ভোটাধিকার, ছিলো না মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিগত নির্বাচনগুলো ছিলো প্রহসনের নির্বাচন।

২০১৪ সনে বিরোধীদল বিহীন নির্বাচনে ১৫৪টি সংসদীয় আসনে কোন ভোট হয়নি, বিনা ভোটে নির্বাচিত হন ১৫৪ জন সংসদ সদস্য। হাতের চুড়ি যেমন আয়নায় দেখার প্রয়োজন হয় না তেমনি ২০১৮ সনের সংসদ নির্বাচনে স্বচ্ছতার পক্ষে কোন যুক্তি দাঁড় করানো যায় না, কারণ নির্বাচন কমিশন নিজেরাই স্বীকার করেছেন পরের ভোট আর রাত্রিতে হবে না।

নির্বাচন কমিশনের সরল স্বীকারোক্তির কারণে ২০১৮ সনের ঐ ভোটের সরকারকে নিশি রাতের সরকার বলে ডাকা হতো। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ভোটাররা যদি ভোট দিতে না পারে তাহলে তাদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ মনে বাসা বাঁধতে থাকে। ঐ অবস্থায় আসে ২০২৪ সনের নির্বাচন। বাংলার মানুষ আশা করেছিলো তারা হয়তো এইবার নিজের ইচ্ছে মতো ভোট দিতে পারবে, কিন্তু সে গুড়েও বালি।

প্রায় অধিকাংশ দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগ সরকার আমরা আর মামারা মিলে নির্বাচন করার নতুন ফর্মুলা বের করেন। নিজের দলের প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তারা নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার নতুন কৌশল অবলম্বন করে, সঙ্গে যোগ দেন স্বৈরাচার এরশাদের দল।

যে দলটি বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ জোর করে ক্ষমতা দখল করে রাখেন এবং বন্দুকের নলের জোরে নয় বছর দেশ শাসন করেন। নবাব সিরাজদ্দৌলা নাটকে একটা ডায়লক ছিলো, পাপ যে চাপা থাকে না হোসেন কুলি খান প্রাণ দিয়ে তা প্রমান করে গেছেন, তুমি কি তোমার নিজের জীবনটা দিয়ে আর একবার প্রমাণ করতে চাও।

তেমনি  মোহাম্মাদ এরশাদ নয় বছর দেশ শাসন করে তের বছর জেল মাথায় নিয়ে স্বৈরাচার উপাধি ধারণ করে ইতিহাসের অধ্যায়ে কলঙ্কিত হয়ে রয়েছেন। এদেশের গণতন্ত্র ধ্বংসের পিছনে যদি কোন দলের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে তাহলে সেটা জাতীয় পার্টির। নিজে জোর করে ক্ষমতা দখল করেছে এবং পরবর্তীতে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় থাকার পথকে সুবিন্যস্ত করেছে, এই দল যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাতানো কোন নির্বাচনে না যেত তাহলে অনেক আগেই এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতো।

জাতীয় পার্টি যেভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন সে প্রশ্ন না তুলে জাতীয় পার্টিকে দেশের মানুষ এক সময় ৩য় দল হিসাবে ভাবতে শুরু করেছিলো। কোন সময় দেশের ১ম ও ২য় দল যদি মানুষের আশা আঙ্খাক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে না পারে সেক্ষেত্রে জনগণ ৩য় দলের উপর ভরসা রাখে কিন্তু জাতীয় পার্টি লেজুরবৃত্তি করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে ভরসাতো দুরের কথা মানুষ আর তাদের বিশ্বাসই করে না।

তার বড় প্রমাণ ২০১৪ সনের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা ছিলো ৩৪টি, ২০১৮ সনে আসন ছিলো ২২টি আর ২০২৪ সনে এই দলের আসন ছিলো মাত্র ১১টি। ২০২৪ সনের ৭ই জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা পায় ২২৩টি আসন এবং আওয়ামী লীগের দলীয় তবে তথাকথিত স্বতন্ত্র যারা আসন পায় ৬২টি যার মধ্যে ৫৯জনই আওয়ামী লীগের নেতা, আর জাতীয় পার্টিকে করুণায় দেওয়া হয় মাত্র ১১টি আসন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ দোর্দন্ড প্রতাপের সঙ্গে সরকার গঠন করে দেশ চালাতে থাকে, কিন্তু জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বার বার তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির দেহে ক্ষয়রোগ বাসা বাঁধতে থাকে সে কথা আওয়ামী লীগ বেমালুম ভুলে যায়। বিএনপিসহ সকল বিরোধী দল দীর্ঘদিন যাবৎ একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।

শুরু হয় বিরোধী দলের প্রতি হামলা-মামলা। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা কর্মীর উপর মিথ্যা মামলার খড়গ নেমে আসে। অনেক নেতা কর্মীকে প্রেপ্তার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে, রিমান্ডের নামে তাদের উপর চালানো হয় অ-মানবিক নির্যাতন। দলের বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে ৫ শতাধিক পর্যন্ত মামলা এখনও বিদ্যমান আছে।

স্বচ্ছ রাজনীতিবিদ হিসাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটা সুনাম ও সুখ্যাতি রয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধেও শতাধিক মামলা বিদ্যমান। এই সকল রাজনীতিবিদ খুন-ডাকাতি কেসের আসামি নয়, তাঁরা মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যে মামলায় আসামি হয়েছেন।

সংবিধান মানুষকে রাজনীতি করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, অথচ এই রাজনীতি করতে গিয়ে সরকারি দলের কাছে কতভাবেই না বিরোধী দল নিগৃহীত হয়েছে তার হিসাব নেই।

এতো গেল মামলা হামলার কথা। বিরোধী দল একটি দোওয়ার অনুষ্ঠান করবে সেখানেও বাঁধা। রাজপথে মিটিং মিছিলে বাঁধা, সমাবেশে বাঁধা, হামলা মারপিট নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি সরকারি দল নিজেরা মারামারি করে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা করার বহু খবর পত্র- পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে। আর এই সকল কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেছে আওয়ামী লীগের দলীয়ভাবে নিয়োগ পাওয়া কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ।

এক সময় থানার মেইন গেটে লেখা থাকতো পুলিশের কাজ দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, আসলে ওই পর্যন্তই, তারা দুষ্টকে লালন পালন করেছে এবং শিষ্টকে দুরে ঠেলে দিয়েছে। অনেক সময়ই টাকার জন্যে তারা অনেক ভালো লোককে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে মিথ্যে মামলা দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করছে। অ-মানসিক নির্যাতনের কারণে ২৮শে আক্টোবরের পর এক জেলখানায় মারা যায় বিএনপির ১৫জন নেতাকর্মী, ঐ সময় পর্যন্ত মোট মামলা হয় ১৬৪৫টি, আর গ্রেপ্তার হয় মোট ২৫৭১১জন।

এ হিসাব শুধু ২০২৩ সাল পর্যন্তই। ৭ই জানুয়ারী/২০২৪ তারিখের পর মৃত্যুর হিসাব বাড়তে থাকে। শুধু কি মিথ্যা মামলা। ‘আয়না ঘর’ নামে আলাদা টর্চার সেল বানানো হয়। শুধু রাজনীতি করার কারণে নিরাপরাধ লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে সেই আয়না ঘরে বন্দি করে রাখা হতো, প্রতিবাদ করলে তাদেরকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলতো।

বিএনপির মতো একটি বৃহৎ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াছকে ধরে নিয়ে গিয়ে হয়তো গুম করা হয়েছে, দীর্ঘদিন হয় তাঁর পরিবার ইলিয়াছের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে। মায়ের ডাক নামক একটি সংগঠন আছে, যে সংগঠনের সদস্যদের চোখের পানি পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে শুকিয়ে গেছে।

রাজনৈতিক নেতাদের মামলা দিয়ে যখন তাদের নিঃশেষ করে ফেলা অবস্থা তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। পুলিশসহ দলীয় ছাত্রলীগের ক্যাডার দিয়ে তাদের উপর হামলা চালানো হয়। এক সময় এই আন্দোলন এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়, তার পরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি।

ছাত্রদের আন্দোলন নিয়ে মন্ত্রী এমপিরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বক্তব্য দেওয়া শুরু। আওয়ামী লীগের বর্ষিয়ান নেতাদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু সহ আরো অনেক ভারী ভারী নেতা এক সময় মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলো তাঁরা কোন সময়েই কোন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে কোন অশালীন বক্তব্য দেয় নাই বা কোন টিটকারীমূলক কথা বলে নাই বরং আওয়ামী লীগের অনেক তরুণ নেতা বিরোধী দল নিয়ে অনেক আজে-বাজে মন্তব্য করেছে।

আসলে অভিজ্ঞতা না থাকলে যেটা হওয়ার সেটাই হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক লোক সাইন বোর্ড লেখার দোকান দিয়েছে। দোকানদার একটা হেলপার রেখেছে, তার আবার লেখাপড়া কম। থানা লিখতে দিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলুন, বিপদে পড়লে পাশে ডাকুন, ম্যারেজ হল লিখতে দিয়েছে, আপনার ভবিষ্যৎ জীবন সুখ ও সম্মৃদ্ধিতে ভরে উঠুক, মদের দোকানে ঝামেলা হয়, সে লিখতে দিয়েছে, এই দোকানটা বিক্রি আছে, মহাশশ্মান লিখতে দিয়েছে পরপারে স্বাগতম।

যথারীতি লেখাও হলো, বিপত্তি হলো সাইনবোর্ডগুলো ভুল-ভাল জায়গায় লাগানো হলো। হেলপার মহাশশ্বানে লাগালো আপনার ভবিষ্যত জীবন সুখ ও সম্মৃদ্ধিতে ভরে উঠুক, মদের দোকানে লাগানো হলো, আইন শৃঙ্খলা মেনে চলুন,বিপদে পড়লে পাশে ডাকুন, ম্যারেজ হলে লাগানো হলো পরপারে সু-স্বাগতম. সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো থানায় লাগালে হলো এই দোকানটা বিক্রি আছে। বুঝেন এখন অবস্থা। আওয়ামী লীগ সরকারের হয়েছিলো ঠিক এই রকম অবস্থা।

ছাত্র জনতার আন্দোলনে এক সময় স্বৈরাচার হাসিনা এবং তার দোসরা আন্দোলনকারী নিরীহ ছাত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে শত শত নিরীহ ছাত্র জনতাকে হত্যা করে, হাজার হাজার লোক জখম হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এক সময় এদেশে সিপাহী-জনতার বিপ্লব হয়েছিলো, এবার হলো ছাত্র-জনতার বিপ্লব।

অবশেষে সমস্ত অশুভ শক্তিকে পরাভূত করে ছাত্র জনতার রক্তে নতুন করে বিজয়ের ইতিহাস লেখা হলো। আবারও প্রমাণ হলো জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।


লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক
বগুড়া জেলা এ্যাডভোকেটস্ বার সমিতি

01711-197719



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS