ভিডিও

বন্যা, বাংলাদেশ ও বাঁধ

প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৪, ০৫:৩৮ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ২৬, ২০২৪, ০২:৩৮ দুপুর
আমাদেরকে ফলো করুন

বন্যা নদীবিধৌত বাংলাদেশে অতিপরিচিত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা তুলনামূলকভাবে পানির উচ্চ প্রবাহ, যা কোন নদীর প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রম করে পানি আশপাশের সমভূমি প্লাবিত করলে সাধারণত জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্লাবনভূমি যেহেতু মানুষের কাঙ্খিত ও কৃষিকাজের সহায়ক, তাই বন্যাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ও এর ক্ষয়ক্ষতি যাতে সীমা ছাড়িয়ে না যায় তা লক্ষ্য রাখা জরুরি। বাংলাদেশে বন্যার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র। বর্ষাকালে যখন নদী, খাল, বিল, হাওর ও নিচু এলাকা ছাড়িয়ে সমস্ত জনপদ পানিতে ভেসে যায় এবং ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সহায়-সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে বন্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়। 

বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়: ক) মৌসুমি বন্যা-এই বন্যা ঋতুগত, নদনদীর পানি ধীরে ধীরে উঠানামা করে এবং বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে; খ) আকস্মিক বন্যা-আকস্মিক পাহাড়ি ঢল অথবা স্বল্প সময়ে সংঘটিত প্রবল বৃষ্টিপাত থেকে কিংবা প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট বাঁধ ভেঙে সংঘটিত হয় এবং গ) জোয়ারসৃষ্ট বন্যা: সংক্ষিপ্ত স্থিতিকাল বিশিষ্ট এই বন্যার উচ্চতা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং ভূভাগের নিষ্কাশন প্রণালীকে আবদ্ধ করে ফেলে।

বাংলাদেশের বন্যা সংঘটনের জন্য বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি কারণকে দায়ী কারেন। কারণগুলো হলো : ১) সাধারণভাবে নিম্ন উচ্চতাবিশিষ্ট ভূসংস্থান যার উপর দিয়ে প্রধান প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীগুলি তাদের শাখা-প্রশাখা এবং উপনদীর সমন্বয়ে ঘন বিন্যস্ত নিষ্কাশন জালিকা গড়ে তুলেছে ২) দেশের বাইরে নদনদীর উজান এলাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে ভারি বৃষ্টিপাত; ৩) হিমালয় পর্বতে তুষার গলন এবং প্রাকৃতিকভাবে হিমবাহের স্থানান্তর; ৪) পলি জমার ফলে নদনদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া/নদীর পার্শ্বদেশ দখল হয়ে যাওয়া/ভূমিধ্বস; ৫) প্রধান প্রধান নদীসমূহে একসঙ্গে পানি বৃদ্ধি এবং এক নদীর ওপর অন্য নদীর প্রভাব বিস্তার; ৬) প্রকৃতির ওপর মানবীয় হস্তক্ষেপ; ৭) জোয়ারভাটা এবং বায়ুপ্রবাহের বিপরীতমুখী ক্রিয়ার ফলে নদনদীর সমুদ্রমুখী প্রবাহ ধীরগতি প্রাপ্ত হওয়া; ৮) সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া; ৯) ভূ-গাঠনিক বিশৃঙ্খলা (ভূমিকম্প, নদীর প্রবাহ ও ভূরূপতত্ত্বে পরিবর্তন); ১০) সম্ভাব্য গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি। 

বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, হিমালয় থেকে উৎসরিত ৩টি বৃহৎ নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার পলল দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে। এটি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ বদ্বীপ। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। এ নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি হচ্ছে আন্তঃসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। আবহমানকাল ধরে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা আবর্তিত হচ্ছে এসকল নদীর পানিকে ঘিরে। এ তিনটি নদীর অববাহিকার মোট আয়তন প্রায় ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত। এসকল নদীর অন্যান্য অববাহিকাভূক্ত দেশ হচ্ছে ভারত, নেপাল, ভূটান ও চীন। 

বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস : আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে বন্যার ইতিহাসও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় এই বদ্বীপ  প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, ব্যাপকতায় যা ১৯৮৮ সালের প্রলয়ংকরী বন্যার প্রায় সমান। বাংলাদশে বন্যা একটি বারংবার ঘটা একটি প্রাকৃতিক দূর্যোগ। পরিসংখ্যানের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশেজ্ঞদের মতে, ব্যাপক বন্যা প্রতি সাত বছরে একবার এবং মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা প্রতি ৩৩-৫০ বছরে একবার এই জনপদে হানা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দেশে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ২০০০ সালে ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৫টি দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা বন্যায় বিধ্বস্ত। প্রায় ৩০ লাখ লোক গৃহহীন। বন্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মাটির বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কারণে ঘটে বলে বাংলাদেশ কে জানায় ভারত।

২০১৭ সালের বন্যা
বাংলাদেশে অঞ্চলভেদে ২০১৭ সালের বন্যা ভয়াবহতা ছিল ব্যাপক। তবে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার তুলনায় ২০১৭ সালের বন্যার ব্যাপকতা কম ছিল। তবে পানিপ্রবাহ ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এই বন্যা মাত্রা এলাকাভেদে ভিন্নতা রয়েছে। বিশেষ করে রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও নীলফামারী এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এসব জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যার পানির স্রোতে ভেঙ্গে যায় সড়ক, মহাসড়ক, বেড়িবাঁধ ও রেললাইন। এই বছরে ভারত, নেপাল ও ভুটানেও ব্যাপক বন্যা হয়।

২০২২ সালের বন্যা : সিলেট বিভাগে এই বন্যা হয়। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও অনেক বেশি ছিল। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলোভীবাজার, কিশোরগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা প্লাবিত হয়। সিলেট বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করেন। এবারও প্রতিবেশী ভারত জানায় বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া আকস্মিক বন্যায় তাদের কোন পদক্ষেপ দায়ী নয়, অতিবৃষ্টি ও উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল।
২০২৪ সালের বন্যা : আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লাসহ আটটি জেলা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জেলায় আকস্মিক বন্যার বিষয়ে পূর্ব সতর্কতা থাকলেও যে মাত্রায় বন্যা হচ্ছে সে বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য ছিল না বাংলাদেশের কাছে। এ ধরনের আকস্মিক ও প্রবল মাত্রার বন্যার জন্য প্রস্তুতি নেয়াটা 'কঠিন' বলে জানাচ্ছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। আকস্মিক এ বন্যার বিষয়ে অন্তত তিন দিন আগে থেকে সতর্কতা ছিল এবং বিপজ্জনক মাত্রা অতিক্রম করার পূর্বাভাসও ছিল বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের। উজানে নদনদীর তথ্য নিয়মিত জানতো পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র, গোমতী নদীতে ভারতের অমরপুর পয়েন্ট থেকে ডাটাও দেওয়া হয় বাংলাদেশকে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি’র বাংলাদেশ শাখায় জানিয়েছেন পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

অমরপুর পয়েন্ট ভারত-বাংলাদেশ থেকে ৮০ কি.মি উজানে। সেখান থেকে ভারত কর্তৃপক্ষ সবসময়ই তথ্য শেয়ার করে বাংলাদেশেরসাথে। নিয়মিতভাবেই এ তথ্য পেয়েছেন বলেও বিবিসি কে দেওয়া সেই স্বাক্সাতকারে নিশ্চিত করেন ঐ কর্মকর্তা। উজানে পানি বাড়ার অন্তত একদিন আগে থেকেই বাংলাদেশ জানতো বলেও তথ্য দেন তিনি। ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ার ফলে বন্যার এ মাত্রা কি না-এ বিষয়ে কোনো তথ্য ছিলো না পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কাছে। যদিও অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সাথে অসহযোগিতা করছে। বৃহস্পতিবার ২ আগস্ট ২০২৪ বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টাদের এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উজানের পানি ধেয়ে এসে এই বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে এবং কোনো প্রকার আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেবার সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে।’ আবার, বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তির গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা বলছে , বাংলাদেশ অন্তত একদিন আগে থেকেই জানতো উজানে পানি বাড়বে! সেই তথ্যকে গুরুত্ব দিয়েও যদি আমরা প্রস্তুতি নিতাম তাহলে জানমালের ক্ষতি কিছুটা হলেও প্রশমন করা যেতো। ২০২৪ সালের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আবহাওয়ার কেবল দেশের কোথায় কোথায় বৃষ্টির সম্ভাবনা আর সমুদ্র উপকূলে বিপৎসংকেত দেখানোর নির্দেশনায় সীমাবদ্ধ থাকার দিন শেষ হয়ে এসেছে বলে মত দিচ্ছেন দেশের বিশেষজ্ঞরা। 

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অভিন্ন নদীর ব্যাপক জরিপ কার্যক্রম পরিচালন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রধান প্রধান নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের উপর সমীক্ষা পরিচালন, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার এবং বাংলাদেশের সাথে ভারত সংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রীড সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে সর্বাধিক যৌথ ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদীসমূহ থেকে সর্বোচ্চ সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের স্ট্যাটিউট স্বাক্ষরিত হলেও ভারতের একক কর্তৃত্ব বাংলাদেশ’কে বরাবরই পানি বন্টন, আকষ্মিক বন্যা, খড়াসহ নানাবিধ অপ্রকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি করছে বহুকাল থেকেই। চলতি মাসের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যত্থানের মধ্য দিয়ে ভারতের সাথে অতিসখ্যতা বজায় রাখা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এসব নানা দ্বৈত চুক্তির বিষয়ে তৎকালীন সরকারের নিরব ভূমিকাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এবারের চলমান এই আকষ্কিক বন্যায় রবিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪ দুপুর পর্যন্ত সরকারি দেওয়া তথ্য মতে, দেশে ১৮ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ বন্যা পরবর্তী সময়ে নিরূপণের সাথে সাথে, অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে আকষ্মিক এ বন্যা কী আসলেই ভারতের বাধের বন্যা না কি প্রাকৃতির বিচার !

হাসান মোঃ শাব্বির
সাব-এডিটর, দৈনিক করতোয়া ( অনলাইন )

 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS