ভিডিও

স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন সময়ের দাবি

অচিন্ত্য চয়ন

প্রকাশিত: আগস্ট ২৯, ২০২৪, ০৫:৫৬ বিকাল
আপডেট: আগস্ট ২৯, ২০২৪, ০৫:৫৬ বিকাল
আমাদেরকে ফলো করুন

ব্যাংক খাতে অনিয়ম- বিষয়টি অনেকটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছিলো। গেল সরকারের সময়েই ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করেছে। এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এসব বিশৃঙ্খলা রোধে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া অর্থ আত্মসাৎ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়াই এর প্রমাণ।

আর অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ দেয়ার কারণেই ঋণ খেলাপীর অংক বেড়েছে, ফলে ক্রমেই অর্থনৈতিক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটি দেশের খুঁটি হচ্ছে অর্থনীতি, এই খুঁটিই  যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে সেই দেশে সার্বিক অবস্থায় বিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে। রাজনৈতিক প্রভাবে এমন অনিয়মের পাহাড় গড়লেও এ ব্যর্থতার দায়ভার কেন্দ্রিয় ব্যাংকের- এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দাবিতে ব্যাংকগুলোয় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সেসব ব্যাংকের লেনদেনও। আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় তাই ব্যাংকগুলোয় দ্রুত শৃঙ্খলা ফেরাতে গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলার এবং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

এদিকে সরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কর্মীরা চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। যে কোনো সময় এই ক্ষোভ প্রকাশ্য রূপ নিতে পারে-এমন আশঙ্কাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠনের পর জনগণ আলো দেখতে পাচ্ছেন। এমন প্রত্যাশা করাও অমূলক নয়- বর্তমান বাংলাদেশ তারুণ্যের। তরুণের হাতে আজ সোনার বাংলা।

সার্বিক দিক দেখে মনে হচ্ছে- ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’। এই প্রবাদটি সত্য প্রমাণও করেছে- আওয়ামী সরকারের অনিয়ম-দুঃশাসন, যার চিত্র ক্রমেই উঠে আসছে। তাদের শাসনামলে কমবেশি সব খাতেই অনিয়ম-দুঃশাসন ছিল। তবে একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি অর্থনৈতিক খাত, খাতটি একেবারে নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংকগুলোর অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা আর্থিক চিত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা রাজনৈতিক। আওয়ামী সরকারের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের দেড় দশকের ক্ষমতার প্রভাবে সংকট বেড়েই চলেছে। দলীয় প্রভাবের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক কার্যক্রম মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

বেশ কয়েকটি ব্যাংক তো সরাসরি আওয়ামী লীগের দখলে চলে গেছে বলেও সংশ্লিষ্টদের অনেকের অভিযোগ। সম্প্রতি গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের পতনের পর সেসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। তবে কয়েকটি ব্যাংক, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আমলে দখল হওয়া তিনটি ব্যাংকে গত কয়েকদিন ধরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের কোমর ভেঙে দিয়েছে। এরপরও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ মানতে নারাজ ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকার।

উন্নয়নের ধারা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে- তারা এমন দাবিও করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন- ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ডলারের দামের অস্থিতিশীলতা, রিজার্ভের ঘাটতি, দেশি-বিদেশি পর্যায়ে ঋণের দায় বৃদ্ধি, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ হ্রাস; সর্বোপরি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে অর্থ লুট হওয়ায় এ খাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে- ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশ বা জিডিপির ২ শতাংশের সমান।

অন্যদিকে বর্তমানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য অনেক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। যার ফলে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। অবাক করা আরেকটি তথ্য বেনামে ঋণ দিয়ে ৭ হাজার ৯২৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের পাহাড় গড়েছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)।

ব্যাংকটি দীর্ঘদিন তথ্য গোপন রাখলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ দেখিয়েছে ১৬৪৪ কোটি টাকা।

এখানে ৭৯২৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করে এসআইবিএল। মূলত, দুর্বল করপোরেট শাসন ব্যবস্থা, আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং স্বচ্ছতার অভাব বাংলাদেশের ব্যাংক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেছে। এখানে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করে এমন সব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যাদের আসল আগ্রহ অন্যত্র। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী গ্র“পের মালিকরা ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করেছে।

এ চিত্র একটি দেশের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে দ্রুত শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পর্যায়ক্রমে দখলে থাকা ব্যাংকগুলো নিয়মের মধ্য দিয়ে প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি যেসব অনিয়ম হয়েছে, সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির স্বার্থে দ্রুত ব্যাংক খাতের ধস ঠেকানো ও শৃঙ্খলা ফেরানো প্রয়োজন।

ব্যাংক খাতসহ অর্থনৈতিক পরিবেশ যথাসম্ভব দ্রুত স্বাভাবিক করতে না পারলে সংকট আরও বাড়তে পারে, বিনিয়োগ কমতে পারে; ফলে থমকে যেতে পারে অর্থনীতি। বলা বাহুল্য, ব্যাংকিং খাতে চরম অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে।

ব্যবসা পরিচালনার নামে দেশের তফসিলি ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে হজম করে ফেলেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের টাকা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের আমানত, তাই এ খাতের দুর্বৃত্তদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার অবকাশ নেই। দ্রুত এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব না হলে আরও ভয়াবহতা দেখা দেবে, এতে আমাদের দেশের তরুণ সমাজের স্বপ্ন ভেস্তে যাবে।

বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। যত আইন করা হোক, কোনো লাভ নেই, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সম্পদ জব্দ করে জনগণের শ্রম-ঘামের আমানত উদ্ধার করতে হবে।

ব্যাংক খাতে দুষ্ট চক্র ভেঙে ফেলতে এবং স্বচ্ছতা আনতে তাই একটি সুনির্দিষ্ট, সময়োপযোগী, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, জবাবদিহিমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সবার মাঝেই প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছে। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টার জন্য অর্থনীতির এসব পরিচিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হবে নিশ্চয়ই।

স্বচ্ছতার স্বার্থে এ খাতের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরাও দরকার। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আর্থিক খাতের সংস্কার সময়ের দাবি। তাই দেশের অর্থনীতির গতি বেগবান করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করবে- এটাই প্রত্যাশা।

ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হলে প্রথমেই ঋণখেলাপিসহ প্রতিটি অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা-পরিচালকদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠনসহ রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে যেন রিকভারি এজেন্টরা যেন জিম্মি হয়ে না পড়ে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

তবে তারুণ্যের বাংলাদেশে আসবে স্বচ্ছতার আলো-অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে জনগণের বিশ্বাসের জায়গা। সর্ষের ভেতর থেকে ভূত তাড়িয়ে স্থাপন করা হোক-স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত, স্থায়ী হোক জনগণের আস্থার মিছিল।


লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

adreechoyon86@gmail.com

01713-477784 



মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, দৈনিক করতোয়া এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়
H009
KCS